চকলেট খেতে অনেকেই পছন্দ করেন। কিছু চকলেট মুখে দিলেই মন ভরে যায়, আবার কিছু চকলেট তেমন ভালো লাগে না। চকলেটের এই স্বাদের ভিন্নতার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। বিজ্ঞানীদের তথ্যমতে, চকলেটের স্বাদ কেবল কোকোগাছের ওপর নির্ভর করে না। চকলেট সুমিষ্ট ও স্বাদের হয় আসলে ইস্ট ও ব্যাকটেরিয়ার এক জটিল গাঁজনপ্রক্রিয়ার কারণে। সম্প্রতি নেচার মাইক্রোবায়োলজি সাময়িকীতে প্রকাশিত একটি গবেষণা ফলাফলে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
বিজ্ঞানীদের তথ্যমতে, মাটি, বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রার কারণে বিশেষ স্বাদ তৈরি হয় কোকোগাছে। ফলে চকলেটে কোকোগাছের উৎপত্তিস্থলের নিজস্ব স্বাদ পাওয়া যায়। ভিন্ন স্বাদের পেছনে আসলে বুনো অণুজীব বেশি প্রভাব রাখে। কোকো বিন বা বীজকে অণুজীব স্বতঃস্ফূর্তভাবে গাঁজন করে। বিজ্ঞানীরা কলম্বিয়ার কোকোগাছের বাগান পর্যবেক্ষণ করে বিভিন্ন অণুজীবকে তালিকাভুক্ত করার পাশাপাশি গাঁজনপ্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করেছেন। এ বিষয়ে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব নটিংহ্যামের উদ্ভিদ জিনবিজ্ঞানী ডেভিড গোপালচান বলেন, চকলেটের স্বাদে কোকোগাছের জিনগত গঠনের ভূমিকা রয়েছে। একই সঙ্গে গাঁজনও স্বাদের ভিন্নতা আনতে বড় ভূমিকা রাখে।
কলম্বিয়ার খামারের তথ্য অনুসরণ করে বিজ্ঞানীরা ইস্ট ও ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে চকলেটের স্বাদ পুনরায় তৈরি করছেন। এ বিষয়ে বিজ্ঞানী গোপালচান বলেন, ‘আমরা বিশেষ ধরনের স্টার্টার কালচার তৈরি করেছি। এই কালচার কোকোচাষিদের আরও নির্ভরযোগ্যভাবে সুস্বাদু চকলেট গাঁজন করতে ও তাদের পণ্যের মান বাড়াতে সাহায্য করতে পারে।’
বিজ্ঞানী গোপালচান ও তাঁর সহকর্মীরা কলম্বিয়ার তিনটি বাগান বেছে নিয়েছিলেন। দুটি বাগানের কোকোগাছে উৎকৃষ্ট মানের চকলেট হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, গাঁজনপ্রক্রিয়ার শুরুতেই কিছু ইস্ট সক্রিয় হয়ে ওঠে। এর মধ্যে রয়েছে স্যাকারোমাইসিস সেরেভিসিয়া নামের একটি ইস্ট। ইস্ট কোকোবীজে থাকা শর্করা ভেঙে অ্যালকোহলে রূপান্তরিত করে। এই প্রক্রিয়াটি তাপ উৎপন্ন করে। গাঁজন শুরুর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাপমাত্রা অনেক বাড়িয়ে দেয়।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোকো রিসার্চ সেন্টারের খাদ্য প্রযুক্তিবিদ ও বিশেষজ্ঞ চকলেটের স্বাদ পরীক্ষক নায়লা আলী বলেন, গাঁজনের তাপমাত্রা ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছানো গুরুত্বপূর্ণ। তখন কোকোবীজের অঙ্কুরোদ্গম ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। ৪৮ ঘণ্টা পর অ্যাসিটিক অ্যাসিড এবং ল্যাকটিক অ্যাসিড উৎপাদনকারী ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। তখন অ্যালকোহল অ্যাসিডে রূপান্তরিত হয়। এতে পিএইচ বৃদ্ধি পায় ও বিন ও শাঁসের আরও বিয়োজন ঘটে। অন্যান্য ইস্ট ও ব্যাকটেরিয়াও এই প্রক্রিয়ায় যোগ দিলে সুস্বাদু অণুতে রূপান্তরিত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলের প্যাসিফিক নর্থওয়েস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ইস্ট জিনবিজ্ঞানী এইমি ডাডলি জানান, তাপমাত্রা ও পিএইচ মাত্রা ওঠানামার সময় ও গতি স্বাদে ভিন্নতা আনে। বিজ্ঞানীরা কিছু নির্দিষ্ট স্বাদের যৌগ তৈরির সঙ্গে সম্পর্কিত জিন খুঁজে বের করেছেন। তাঁরা এমন কিছু অণুজীবের তালিকা তৈরি করেছেন, যেগুলো দুটি বাগানের উৎকৃষ্ট মানের চকলেটের স্বাদে পরিবর্তন আনতে সক্ষম। গবেষণাগারে গাঁজন করা বীজে কমলা ফুলের সুবাস, সাইট্রাস, বেরি, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ফলের আবহ ছিল, যা কলম্বিয়ার দুটি খামার ও মাদাগাস্কারের একটি নমুনা থেকে প্রাপ্ত উৎকৃষ্ট চকলেটের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিলে যায়। যদিও গবেষণাগারের মিশ্রণে ক্যারামেল, বাদামের স্বাদ অনুপস্থিত ছিল।
সূত্র: সায়েন্স নিউজ