গুমের শিকার হয়ে এখনও নিখোঁজ সাতশ’রও বেশি মানুষ। শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলেও এই মানুষগুলোর কোন খোঁজ মিলছে না। এখনও স্বজনদের ফিরে আসার অপেক্ষায় দিন গুণছেন এই পরিবারগুলোর সদস্যরা। আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধি দিবসে শহীদ মিনারে হাজির হয়ে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের সন্ধান ও গুমের সাথে জড়িতদের বিচার দাবি করেছেন তারা।
গুম হওয়া ব্যক্তির স্বজনদের আর্তনাদ-আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ। নিখোঁজদের ফেরত পাওয়ার আকুতি তাদের। শুক্রবার সকালে শহীদ মিনারে উপস্থিত হন গুম হওয়া শত পরিবারের সদস্যরা। সঙ্গে ছিলো গুম হওয়া স্বজনের ছবি আর ফিরে পাওয়া আকুতিতে ভরা সব পোষ্টার।
শেখ হাসিনা সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় নিখোঁজ এদেরই কারও বাবা, কারও সন্তান, কারও স্বামী, কারও ভাই। বছরের পর বছর গুম হওয়া স্বজনের অপেক্ষায় পরিবারের সদস্যরা। তারাই আন্তজার্তিক গুম প্রতিরোধ দিবসে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের ছবিসহ মানববন্ধনে অংশ নেন।
ছোটবেলায় বাবাকে তুলে নিয়ে যায় রাষ্ট্রীয় বাহিনী। এখন স্মৃতি হাতড়েও বাবার কথা মনে করতে পারে না শিশুরা। সেই শিশুরা এখন কিশোর। বাবাকে নিজ চোখে শুধু একবার দেখতে চায় তারা। গুমের সঙ্গে জড়িত সব অপরাধীর তদন্তের মাধ্যমে সুষ্ঠু বিচার দাবি জানিয়েছেন স্বজনরা।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে কান্নাভেজা কণ্ঠে কিশোরী আনিশা ইসলাম বলছিলো, বলা হচ্ছে দেশ দ্বিতীয়বার স্বাধীন হয়েছে, স্বাধীন দেশে আমার বাবাকে ফেরত চাই। তার বাবা ইসমাইল হোসেন বাতেন ২০১৯ সালের ১৯ জুন শাহ আলী মাজার সংলগ্ন তার কাঠের দোকান থেকে নিখোঁজ হন।
২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট ধানমন্ডির স্টার কাবাবের সামনে থেকে নিখোঁজ হন ২০ বছর বয়সী ইশরাক আহমেদ। কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়তেন তিনি। ২০১৭ সালে ছুটি কাটাতে ঢাকায় এসে নিখোঁজ হন। এরপর এখন পর্যন্ত তার কোন খোঁজ বা তথ্য পায়নি ইশরাকের পরিবার।
শহীদ মিনারে ইশরাকের বাবা জামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমার ছেলে যখন নিখোঁজ হয়, আমি রাত ১০টায় ধানমন্ডি থানায় গিয়েছিলাম জিডি করার জন্য । রাত সাড়ে ১০ টায় আমার বাসায় র্যাব আসে। পরে আমি র্যাব-২ এর মেজর আতাউরের কাছে যাই। পরদিন তারা আমার ছেলের ল্যাপটপ নিয়ে যায়।
তিনি বলেন, এক মাস পর ল্যাপটপ ফিরিয়ে দিলেও আমার ছেলেকে তারা ফিরিয়ে দেয়নি। গত সাত বছর ধরে আমরা অপেক্ষা করছি। অনেক জায়গায় দৌড়াদৌড়ি করেছি। কিন্তু আমার ছেলেকে ফিরে পাইনি। নতুন সরকারের কাছে আমার দাবি, আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিন।আমরা এখনও অপেক্ষা করছি।
২০১২ সাল থেকে নিখোঁজ পল্লবী থানার ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক তরিকুল ইসলাম তারা। শহীদ মিনারে তার বাবা নুরুল ইসলাম বলেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে আমার ছেলেকে গুম করা হয়েছে। এতদিন আমরা রাস্তায় দাঁড়াতে পারি নাই। প্রেসক্লাবে একদিন বক্তব্য দেওয়ায় আমাকে দুদিন গুম করার চেষ্টা করেছে। এলাকাবাসী মাইক দিয়ে ডাকাত আসছে ঘোষণা করায় তারা আমাকে নিতে পারে নাই।
২০১০ সালের ২৪ জুন রাজধানীর ফার্মগেট এলাকা থেকে সিটি করপোরেশনের ২০ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার চৌধুরী আলমকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায় গোয়েন্দা সংস্থার পরিচয় দেয়া লোকজন। চৌধুরী আলমের মেয়ে মাহফুজা আখতার মুক্তা বলেন, বাবা হারিয়ে আমরা পাগলপ্রায়। তারপরও আমার রাস্তায় এসে দাঁড়াই, যদি আমার বাবার সন্ধান পাই। স্বাধীন দেশে গুম বলে কিছু থাকতে পারে আমি বিশ্বাস করি না।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও আয়নাঘর থেকে ফিরে আসা মানুষেরা তাদের মনে নতুন আশার সঞ্চার ঘটিয়েছে। নতুন সরকার, নতুন শাসন, আশায় তারা বুক বেঁধেছেন গুম হয়ে যাওয়া স্বজনদের ফিরে পাওয়া যাবে। গুমবিরোধী তদন্ত কমিশন তাদের আশা পূরণে কাজ করছে বলে মনে করছে সংগঠন মায়ের ডাক।
তাদের দাবি, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুমের সাথে জড়িতদের যেন বিচারের আওতায় আনা হয়। গুম হওয়া ব্যক্তিদের ফেরত পাওয়ার পাশাপাশি আয়নাঘর নামক নির্যাতন কারখানা বিলুপ্ত ঘোষণারও দাবি জানিয়েছেন স্বজনরা। শুধু আয়না ঘরই নয়, এ ধরনের সব ব্যবস্থার বিলুপ্তি চেয়েছেন তারা।
একইসঙ্গে ‘আয়নাঘর’ তৈরি করার পেছনের কারিগর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, জাতীয় টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক জিয়াউল আহসানসহ এতে জড়িতদের বিচার দাবি করেন তারা।
গুমের ঘটনা থেকে কেউ কেউ বেঁচে ফিরছেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক একটি রাজনৈতিক দল ইউপিডিএফ-এর সংগঠক মাইকেল চাকমা তাদের একজন। তার প্রশ্ন- রাষ্ট্রের নিরাপত্তা দেয়ার কথা প্রতিটি নাগরিককে, কিন্তু সরকারি বাহিনী কোন আইনি বলে তাদের গুম করেছিল?
সংশোধন নয়, সংবিধান পুনর্লিখনের পক্ষে ড. আলী রীয়াজসংশোধন নয়, সংবিধান পুনর্লিখনের পক্ষে ড. আলী রীয়াজ
৫ বছর ৩ মাস আয়নাঘরে আটকে থেকে ৭ আগস্ট মুক্ত হন রাজনীবিদ মাইকেল চাকমা। বন্দি সময়ের কষ্ট ও কাছের মানুষদের কাছে ফিরে যাবার আকুতির কথা তিনি ভুববেন না কোনোদিন। তিনি বলেন, আমার পরিবারের মতো অসংখ্য পরিবারের এই কষ্ট মাসের পর মাস বছরের পর বছর যেন বয়ে যেতে না হয়। গুমের ঘটনায় জড়িতদের অবশ্যই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
আইন ও শালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে ২০০৭-২০২৩ সাল পর্যন্ত অপহরণ করা হয়েছে ৬২৯ জনকে, ফিরে এসেছেন ৬২ জন, নিখোঁজ আছেন ৩৮৩ জন। মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে ৭৮ জনের।