ফিলিস্তিনের গাজা ভূখণ্ডে ইসরায়েলের বর্বরোচিত হামলা ও গণহত্যামূলক যুদ্ধ নিঃসন্দেহে একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক সংঘাতের মধ্যে একটি। গত ৭ অক্টোবর শুরু হওয়া যুদ্ধে এক বছরে সেখানে নিহত হয়েছেন ৪১ হাজার ৮৩৫ জন, আহত ৯৬ হাজার ৯১০ জন। ১০ হাজারের বেশি মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে নিখোঁজ হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
এই হামলায় কেবল বেসামরিক বাসিন্দাদেরই লক্ষ্য করা হয়নি বরং ভূখণ্ডটির অধিকাংশ অবকাঠামোই ধ্বংস হয়ে গেছে, হতাহতের শিকার বহু স্বাস্থ্যকর্মী। সেই সঙ্গে বাড়িঘর, স্কুল এবং আশপাশের গোটা এলাকা ধ্বংস হয়ে গেছে। এক বছর পর, সংবাদমাধ্যম আনাদোলু এজেন্সি গাজায় সংঘটিত বিভিন্ন ধরনের ধ্বংসযজ্ঞের দিকে নজর দেয়।
শিক্ষা ব্যবস্থার ধ্বংস (এডুসাইড) : ইসরায়েলের নির্বিচারে বিমান হামলা গাজায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উল্লেখযোগ্য ক্ষতি করেছে।
এবিসি নিউজ অনুসারে, বাস্তুচ্যুত মানুষের আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহৃত স্কুল ভবনে ১ জুন থেকে ১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ইসরায়েলি বিমান হামলায় কমপক্ষে ৩৫৪ জন নিহত হয়েছেন।
যুদ্ধের কারণে গাজার সাত লাখ ১৮ হাজারের বেশি ছাত্র-ছাত্রীর শিক্ষাব্যবস্থা ব্যাহত হয়েছে। মোট ৪৫৬টি স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে ২৭ আগস্ট পর্যন্ত ৫২৯ শিক্ষক ও প্রশাসনিক কর্মচারীসহ ১০ হাজার ৮৮৮ জনেরও বেশি স্কুলছাত্র নিহত হয়েছে। গাজায় মোট ১৭ হাজার ২১২ শিশু এবং ৩ হাজার ৬৮৬ শিক্ষক আহত হয়েছেন।
পূর্ব জেরুজালেমসহ অধিকৃত পশ্চিম তীরের শিশুরাও স্কুল বছর শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখী হয়েছে।
ইউনিসেফ রিপোর্ট করেছে যে অক্টোবর ২০২৩ সাল থেকে ক্রমবর্ধমান সহিংসতা এবং চলাচলের বিধিনিষেধ এই অঞ্চলের সাত লাখ ৮২ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য শেখার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত বাধা তৈরি করেছে।
পরিবেশের ধ্বংস (ইকোসাইড) : গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যামূলক যুদ্ধ এবং যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহারের কারণে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। ইউরোপীয় আইন ইনস্টিটিউটের সংজ্ঞা মতে ‘ইকোসাইড’ বলতে বুঝায় মানুষ হত্যার জন্য পরিবেশ ধ্বংস করাকে বুঝায়। এই ধারণাটি সত্তরের দশকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় মার্কিন জীববিজ্ঞানের অধ্যাপক আর্থার গ্যালস্টন প্রবর্তন করেছিলেন। শত্রু বাহিনীর নিয়ন্ত্রিত এলাকায় গাছপালা এবং ফসল নির্মূল করতে মার্কিন সামরিক বাহিনী যে ভেষজনাশক এবং ডিফোলিয়েন্ট এজেন্ট অরেঞ্জ ব্যবহার ব্যবহার করেছিলো তা বুঝাতে ব্যবহার করা হয়।
অক্টোবর থেকে জুন পর্যন্ত গাজা পুনর্নির্মাণে আনুমানিক পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ৬ কোটি মেট্রিক টন ক্ষতিকর কার্বন গ্যাস নিঃসরণ হয়েছে।
আবাসন ধ্বংস (ডোমিসাইড): ইসরায়েলের চলমান হামলা গাজায় অধিকাংশ বাড়িঘর ও অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে। দি হাউজিং, ল্যান্ড অ্যান্ড প্রপার্টি টেকনিক্যাল ওয়ার্কিং গ্রুপের সেপ্টেম্বরের প্রতিবেদন মতে, গাজায় কমপক্ষে দুই লাখ ৯৭ হাজার ঘর-বাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, ৮৭ হাজার সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে।
গাজার গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোর ক্ষতির আনুমানিক খরচ প্রায় ১৮৫ কোটি ডলারের বেশি। এই মধ্যে ৭২ শতাংশ খরচ হতে পারে আবাসন খাতে, ১৯ শতাংশ পানি, স্বাস্থ্য, এবং শিক্ষাসহ সরকারী পরিষেবার অবকাঠামো মেরামতে এবং ৯ শতাংশ বাণিজ্যিক ও শিল্প ভবনগুলো সচল করতে।
জাতিসংঘের মতে, গাজা উপত্যকার অন্তত ১৯ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত, এদের মধ্যে অনেকে একাধিকবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ধ্বংস: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এর তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে ২৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে গাজায় ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে লক্ষ্য করে ৫১৬টি এবং পূর্ব জেরুজালেমসহ অধিকৃত পশ্চিম তীরে ৬১৯টি হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী।
স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ওপর হামলায় ৭৬৫ জন নিহত হয়েছেন। ১১০টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এর মধ্যে ৩২টি হাসপাতাল এবং ১১৫টি অ্যাম্বুলেন্স। পূর্ব জেরুজালেমসহ অধিকৃত পশ্চিম তীরে ২৫ জন নিহত হয়েছেন এবং ১১১ জন আহত হয়েছেন। লক্ষ্য করে হামলার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৪৪৪টি অ্যাম্বুলেন্স এবং ৫৬টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র।
সংস্কৃতির ধ্বংস: গাজায় ইসরায়েলি বোমা হামলায় অধিকৃত অঞ্চলটির ঐতিহাসিক স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইউনেস্কোর মতে, ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইসরায়েল হামলা চালিয়ে গাজায় ৬৯টি স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এর মধ্যে ধর্মীয় স্থাপনা ১০টি, ঐতিহাসিক স্থাপনা ৪৩টি, ৬টি সাংস্কৃতিক নিদর্শন এবং ৭টি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা।