রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন গুরুতর অসুস্থ বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল। নতুন করে সোমবার তাঁর চিকিৎসায় যুক্ত হয়েছে চীনা মেডিক্যাল টিম। দেশি-বিদেশি চিকিৎসকদের যুক্ত রেখে নিবিড় পর্যবেক্ষণে তাঁর চিকিৎসা চলছে।
এদিকে দেশি-বিদেশি চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগে সমন্বয় করছেন তাঁর ছেলে ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বিদেশে নেওয়ার প্রস্তুতিও নিয়ে রাখা হয়েছে। খালেদা জিয়ার সুস্থতা কামনায় বিএনপির নেতাকর্মী ছাড়াও দেশের সর্বস্তরের মানুষের প্রার্থনা অব্যাহত রয়েছে। তাঁর শারীরিক অবস্থা নিয়ে গুজব না ছড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে বিএনপি।
খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় সহায়তা দিতে সোমবার পাঁচ সদস্যের একটি বিদেশি মেডিক্যাল টিম এভারকেয়ার হাসপাতালে আসে। এ টিমের অধিকাংশ চিকিৎসক চীনের নাগরিক। বিকেল পৌনে ৩টায় হাসপাতালে প্রবেশ করে তারা খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় নিয়োজিত দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠক করেন। খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় নিয়োজিত মেডিক্যাল বোর্ডের মতে, তাঁর শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণে অতিরিক্ত বিশেষজ্ঞ মতামত প্রয়োজন। এর আগেও দেশি-বিদেশি চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় ভালো ফল পাওয়ায় এবারও সেভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।
এদিকে সোমবার দুপুরে বিএনপি চেয়ারপার্সনের গুলশান কার্যালয়ে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের জানান, বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল। চিকিৎসকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে তাঁর চিকিৎসা চলছে। তবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ম্যডামকে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের সংবাদ প্রচারিত হচ্ছে, এটা সঠিক নয়। তিনি খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে গুজব না ছড়ানোর আহ্বান জানান। সেই সঙ্গে তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে কেউ বিভ্রান্ত হবেন না। তাঁর আশু আরোগ্য কামনায় কায়মনোবাক্য মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে সবাই দোয়া করবেন। দলের নেতাকর্মীসহ দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই। ফখরুল বলেন, আমাদের চিকিৎসকরা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। আল্লাহ তাআলার কাছে আমরা সবসময় দোয়া করছি যে, তাঁকে যেন সুস্থ করে দেন এবং তিনি যেন সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসেন।
এদিকে বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার দ্রুত আরোগ্য কামনা করে দেশবাসীর প্রতি দোয়ার আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। সোমবার এক বিবৃতিতে দলের নায়েবে আমির এটিএম আজহারুল ইসলাম এ আহ্বান জানান।
সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, এভারকেয়ার হাসপাতালের ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিটে আগের মতোই ম্যাডামের চিকিসা চলছে। দয়া করে যে যাই বলুক এ বিষষে কারও কথায় কেউ বিভ্রান্ত হবেন না। বিশেষজ্ঞ চিকিসকরা সার্বক্ষণিক ম্যাডামের চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত আছেন। তাদের থেকে যতটুকু জানতে পেরেছি, তাঁর চিকিৎসা চলছে। সবাই দোয়া করুন আল্লাহ যেন তাঁকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দেন সুস্থভাবে।
উল্লেখ্য, ২৩ নভেম্বর থেকে এভারকেয়ার হাসপাতালে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ভর্তি আছেন। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তাঁর ফুসফুসে ইনফেকশন ধরা পড়ায় তাঁর অবস্থা সংকটময় বলে বিএনপির তরফ থেকে জানানো হয়। তাঁকে ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) রেখে চিকিৎসকরা নিবিড়ভাবে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন।
এভারকেয়ার হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক শাহাবুদ্দিন তালুকদারের নেতৃত্বে দেশি-বিদেশি চিকিৎসকদের সমন্বয়ে একটি মেডিক্যাল বোর্ডের অধীনে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা চলছে। তাঁর চিকিৎসা বোর্ডে তারেক রহমানের সহধর্মিণী ডা. জুবাইদা রহমান, যুক্তরাষ্ট্রের জনহোপকিনস বিশ্ববিদ্যালয় এবং যুক্তরাজ্যের লন্ডন ক্লিনিকের চিকিৎসকরাও রয়েছেন। সর্বশেষ চীনা মেডিক্যাল টিমও তাঁর চিকিৎসায় নিযুক্ত হয়েছে। লন্ডন থেকে তারেক রহমান সর্বক্ষণ মেডিক্যাল বোর্ডের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন।
লিভারের জটিলতা, কিডনির কার্যকারিতা কমে যাওয়াসহ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় দীর্ঘদিন ধরে ভুগছেন ৮০ বছর বয়সী বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। ২৩ নভেম্বর হাসপাতালে ভর্তির পর চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে তাঁর চিকিৎসা চললেও এখনো উন্নতি না হওয়ায় বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে। প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা বিএনপির নেতাকর্মীরা এভারকেয়ার হাসপাতালের সামনে অবস্থান করছেন।
সোমবার দুপুরে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আহমেদ আযম খান সাংবাদিকদের জানান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা গত কয়েক দিনে আরও অবনতি হয়েছে। ‘সিসিইউ থেকে আইসিইউ, আইসিইউ থেকে ভেন্টিলেশন, যা-ই বলি না কেন, ম্যাডাম খুব ক্রিটিক্যাল কন্ডিশনে আছেন। এর বাইরে বলার মতো কিছু নেই। শুধু ম্যাডামের জন্য জাতির কাছে দোয়া চাই।
বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান বলেন, বিএনপি চেয়ারপার্সনের স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সব সিদ্ধান্ত চিকিৎসকরা নিয়ে থাকেন। চিকিৎসকরা আনুষ্ঠানিকভাবে যে মুহূর্তে কোনো তথ্য দেবেন, আমরা তা জানিয়ে দেব। এর বাইরে কোনো সূত্র থেকে তথ্য প্রকাশ না করার জন্য গণমাধ্যমের প্রতি বিশেষ অনুরোধ করছি। তিনি জানান, খালেদা জিয়ার চিকিৎসা সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য দিতে গণমাধ্যমকে অনুরোধ করা হয়েছে। ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. এ. জেড. এম. জাহিদ হোসেন ছাড়া অন্য কোনো বক্তব্য ব্যবহার না করতে অনুরোধ করছি। একই সঙ্গে গুজব বা বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাচ্ছি।
সোমবার দুপুরে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে দলের কেন্দ্রীয় নেতা মাহবুব ইসলামের বাসভবনে খালেদা জিয়ার রোগমুক্তি কামনায় বিশেষ দোয়া অনুষ্ঠানে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, খালেদা জিয়া ‘সিসিইউতে পূর্বের মতোই চিকিৎসাধীন আছেন। চিকিৎসা নিয়ে কারও বক্তব্যে বিভ্রান্ত না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার চিকিৎসা ও শারীরিক অবস্থা নিয়ে নানা ধরনের গুজব ও বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে, এতে কেউ যেন কান না দেয়।
তিনি বলেন, খালেদা জিয়া শুধু বিএনপির নেত্রী নন, তিনি শুধু বিএনপির অঙ্গ-সংগঠনগুলোর নেত্রীও নন। আজ সারাদেশের মানুষ পেশাজীবী, সুশীল সমাজ, ছাত্র, যুবক, শ্রমিক ও কৃষক সবাই তাঁর জন্য দোয়া করছেন। তিনবারের সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে ঘিরে গোটা জাতি আজ এক বেদনাবিধুর অবস্থায় রয়েছে। তিনি বলেন, খালেদা জিয়া বন্দি থাকা অবস্থায় নিজের ছোট সন্তান হারিয়েছেন। অনেক নিপীড়ন ও নির্যাতন সহ্য করেছেন। তবুও তাঁকে নিজের দেশ থেকে সরাতে পারেনি। তাঁর বিরুদ্ধে অনেক চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র হয়েছে, অনেক নির্যাতন হয়েছে। একটি ভগ্নস্তূপের মতো জেলখানায় তাঁকে বছরের পর বছর রাখা হয়েছে। তারপরও তাঁকে এই দেশ ও মাটি থেকে সরানো সম্ভব হয়নি। আজ সারা জাতি তাঁর জন্য দোয়া করছেন। তাঁর শারীরিক অবস্থা নিয়ে গুজব-বিভ্রান্তিতে কান দেবেন না। আমরা সবাই আল্লাহর কাছে দোয়া করি, আল্লাহ তাঁকে খুব দ্রুত আরোগ্য দান করুন, সুস্থ করে তুলুন এবং আবারও এদেশের মানুষের কাছে, জনগণের কাছে তাঁকে ফিরিয়ে দিন।
এ সময় বিএনপির স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম, সহ-সম্পাদক মাহমুদুর রহমান সুমন, নির্বাহী কমিটির সদস্য মাহবুবুল ইসলম, ডা. মাহবুবুর রহমান শামীম, ডা. জাহিদুল কবির, সাংবাদিক রাশেদুল হক, ওমর ফারুক কায়সার, ডা. আউয়াল, জাকির হোসেন ও রাজু আহমেদ উপস্থিত ছিলেন।
খালেদা জিয়ার সুস্থতা কামনায় দোয়ার আহ্বান জামায়াতের : বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার দ্রুত আরোগ্য কামনা করে দেশবাসীর প্রতি দোয়ার আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। সোমবার এক বিবৃতিতে দলের নায়েবে আমির এটিএম আজহারুল ইসলাম এ আহ্বান জানান। বিবৃতিতে তিনি বলেন, বেগম খালেদা জিয়া দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং রাষ্ট্রগঠনে দীর্ঘ ত্যাগ, সাহস ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান জাতির ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
জামায়াতের নায়েবে আমির বলেন, ‘মিথ্যা ও সাজানো মামলায় কারাবন্দি রেখে খালেদা জিয়াকে যথাযথ চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল, যা তাঁর শারীরিক ঝুঁকি বাড়িয়েছে। যথোপযুক্ত চিকিৎসা না পাওয়ার কারণে তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে।’ তিনি বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর খালেদা জিয়ার মুক্তিতে দেশবাসীর মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। গণতান্ত্রিক উত্তরণ ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের বর্তমান পরিস্থিতিতে তিনি জাতির জন্য পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করবেন-এমন প্রত্যাশা করছে জনগণ।
এটিএম আজহারুল ইসলাম খালেদা জিয়ার পরিবারের সদস্য এবং বিএনপি নেতাকর্মীদের ধৈর্য ধরার আহ্বান জানান। একই সঙ্গে দেশবাসীর প্রতি তাঁর দ্রুত সুস্থতার জন্য মহান আল্লাহর নিকট দোয়া করার আহ্বান জানান।
খালেদা জিয়া কোনো দলের নয়, সব মানুষের নেত্রী: আব্দুল্লাহ মো. তাহের
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেছেন, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া একজন দেশপ্রেমিক, গণতান্ত্রিক ও আপোসহীন নেত্রী। আজকে উনি কোনো দলের নেত্রী নন। উনি সমগ্র মানুষের নেত্রী। রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালের সামনে সাংবাদিকদের এ সব কথা বলেন তিনি। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে এই হাসপাতালেই ভর্তি ছিলেন তিনি। চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফেরার পথে হাসপাতালের সামনে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। আমি আজকে অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে, উৎকণ্ঠার সঙ্গে, আবেগের সঙ্গে বাংলাদেশের সব মানুষের প্রিয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সুস্থতা কামনা করছি।

