সরকার ইচ্ছা করলে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে অনেক আগেই গ্রেপ্তার করতে পারত বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন। তিনি বলেছেন, ‘এখন খায়রুল হকের বিচার কীভাবে হয়, সেটা দেখার অপেক্ষায় আমরা আছি। সরকারপ্রধানকে বলব, অনতিবিলম্বে এবং সবকিছুর আগে খায়রুল হকের বিচার এমনভাবে করবেন, যেন মানুষ বুঝতে পারে—এ দেশে অবিচার করলে, বিচার বিভাগকে ধ্বংস করলে, কী পরিণতি হয়।’
আজ বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর ধানমন্ডির একটি বাসা থেকে এ বি এম খায়রুল হককে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। এরপর হাইকোর্ট বিভাগের বর্ধিত ভবনের সামনে ব্রিফিংয়ে আসেন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সভাপতি ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ফোরামের সাংগঠনিক সম্পাদক গাজী কামরুল ইসলাম ও আইনজীবী আনিসুর রহমান রায়হান।
জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘আমরা এর মধ্যে একটা সভা করেছিলাম, কেন খায়রুল হককে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না? আমরা তখন বলেছিলাম সরকারের জানা আছে, খায়রুল হক কোথায় আছেন। আজকে ঠিকই দেখলাম যখন একটা বড় রকমের দুর্ঘটনা দেশে ঘটল, যখন পুরোনো প্রশিক্ষণ বিমান দিয়ে…পাইলট ও কোমলমতি শিশু…দেশের মধ্যে একটা অরাজক অবস্থা সৃষ্টি হলো, সে অবস্থায়। ইচ্ছা করলে সরকার এই খায়রুল হককে অনেক আগেই গ্রেপ্তার করতে পারত, আমাদের বিশ্বাস আগেও বলেছি এখনো বলি। তখনো বলেছি খায়রুল হক পালাতে পারেনি এই দেশেই আছে, সরকার ইচ্ছা করলে গ্রেপ্তার করতে পারে। কিন্তু তারপরে এত দিন গ্রেপ্তার করে নাই। কিন্তু আজকে যে গ্রেপ্তার করেছে—এ জন্য আমরা অবশ্যই বর্তমান সরকারপ্রধানকে ধন্যবাদ জানাব।’
‘খায়রুল হকের কারণে আয়নাঘর হয়েছে’
জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সভাপতি জয়নুল আবেদীন অভিযোগ করে বলেন, ‘এই জাতি এবং দেশ এত দিন পর্যন্ত যে জিনিসগুলো দেখেছে, এই খায়রুল হকের কারণে একটি নির্বাচনও সুষ্ঠু হয় নাই। শুধু তা–ই নয়, এই খায়রুল হকের কারণে আয়নাঘর হয়েছে। এই খায়রুল হকের কারণে হাজার হাজার মায়ের কোল খালি হয়েছে। এই খায়রুল হকের কারণে লাখ লাখ অবৈধ মামলা হয়েছে।…তিনি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সম্বন্ধে কটাক্ষ করেছেন।’
জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘জিয়া পরিবারের ওপরে যারাই হাত দিয়েছে, তাদেরই হাত পুড়ে গেছে। এরশাদ হাত দিয়েছিল, এরশাদের হাত পুড়ে গেছে। মঈনুদ্দিন-ফখরুদ্দীন হাত দিয়েছিল, তাদের এই দেশ থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। আর ফ্যাসিস্ট সরকার হাত দিয়েছিল, তাদেরও বিদায় নিতে হয়েছে এবং চরমভাবে বিদায় নিতে হয়েছে। এখন খায়রুল হকের বিচার কীভাবে হয়, সেটা দেখার অপেক্ষায় আমরা আছি। এই খায়রুল হক আমাদের দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন।…এর জন্য খায়রুল হক দায়ী। কোনো অবস্থাতে দায় খায়রুল হক এড়াতে পারেন না। তাই সরকারপ্রধানকে বলব অনতিবিলম্বে এবং সবকিছুর আগে খায়রুল হকের বিচার এমনভাবে করবেন, যেন জনতা বুঝতে পারে এই দেশের মধ্যে অবিচার করলে, একটা বিচার বিভাগকে ধ্বংস করলে, কী হয়।’
মানুষ বছরের পর পর ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি
হাইকোর্ট বিভাগের বর্ধিত ভবনের সামনে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন সাংবাদিকদের বলেন, ‘উনি সেই সাবেক প্রধান বিচারপতি, যাঁর কারণে বাংলাদেশের ১৮-১৯ কোটি মানুষ বছরের পর বছর ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে নাই। তাঁর কর্মকালীন সময়ে, বিচারিক জীবন এবং বিচারের পরবর্তী সময়ে পদক্ষেপগুলো বাংলাদেশে বিতর্ক ও আলোচনার সৃষ্টি করেছে। তাঁর বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত, রায় এবং পদক্ষেপ দেশের গণতন্ত্র, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছে।’
জ্যেষ্ঠ এই আইনজীবী বলেন, ‘খায়রুল হক তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করেছেন, দেশে সংঘাতের সৃষ্টি করেছেন। প্রকাশ্য আদালতে শর্ট জাজমেন্ট দিয়েছিলেন। বিচার করার পরে যখন তিনি প্রধান বিচারপতি নন, এমনকি বিচারপতিও নন—প্রায় ১৬ মাস পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করে। এই রায় বাংলাদেশে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক চাপ, পক্ষপাতিত্ব করে নির্বাচনব্যবস্থাই দুর্বল করেছে, ধ্বংস করে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীও বিনা ভোটে, বিরোধী দলের নেতাও বিনা ভোটে, স্পিকারও ভোট ছাড়া এবং মন্ত্রীরাও ভোট ছাড়া, কিন্তু তারা দেশ চালিয়েছে।…পৃথিবীর কোথাও এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি।’
কেন খায়রুল হক ওই রায় দিলেন, এমন প্রশ্ন রেখে মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ত্রাণ তহবিল থেকে প্রায় ৩৯ লাখ টাকা তিনি চিকিৎসার জন্য সাহায্য নিয়েছিলেন। এটিও রেকর্ড। বিচারপতি পক্ষপাতদুষ্ট হলে কী হয়—আজকে খায়রুল হকের করুণ অবস্থা, গ্রেপ্তার এটাই প্রমাণ করে।…সব সময় বলি বিচারককে হতে হবে মেধাসম্পন্ন, সৎ ও পক্ষপাতিত্বহীন। খায়রুল হক তা ছিলেন না।…জনগণের বিরুদ্ধে তাঁর ওই রায়ের অবস্থান।’ গত ১৫-১৬ বছর বাংলাদেশে যে অরাজকতা, হত্যা, গুম-গ্রেপ্তার, মিথ্যা মামলা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ভোটে কারচুপি বলেন, সবকিছুর জন্য সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক দায়ী বলে মন্তব্য করেন তিনি। ‘মোর ক্যাথলিক দ্যান পোপ’
খায়রুল হককে গ্রেপ্তারের প্রতিক্রিয়ায় হাইকোর্ট বিভাগের বর্ধিত ভবনের সামনে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব কায়সার কামাল বলেন, ‘বাংলাদেশের বিচার বিভাগে এমন একজন ব্যক্তিত্ব পেয়েছিল দেশের মানুষ, যিনি মোর ক্যাথলিক দ্যান পোপ। অর্থাৎ শেখ হাসিনার চেয়ে বড় আওয়ামী লীগার ছিলেন, এই অবিচারক খায়রুল হক। সারা বাংলাদেশের মানুষ তাঁকে চেনে একজন জ্ঞানপাপী হিসেবে। কেন বললাম জ্ঞানপাপী? সুপ্রিম কোর্টের পবিত্র জায়গায় সর্বোচ্চ চেয়ারে বসে তাঁর স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে বিলোপ করেছে। তারপরের ইতিহাস প্রত্যেকেরই জানা।’
বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল বলেন, ‘৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর আমি বলেছিলাম খায়রুল হকের এমন বিচার হওয়া উচিত, যেন ভবিষ্যতে বিচারাঙ্গণে আর নতুন কোনো খায়রুল হকের জন্ম না হয়।…পরবর্তীতে আনফরচুনেটলি বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর গাফিলতি বা অনিচ্ছার কারণে দীর্ঘদিন খায়রুল হক গ্রেপ্তার হননি। যে কারণে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছিলাম।…আমাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে খায়রুল হককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আইনজীবী সমাজ আশান্বিত। তবে তখনই সন্তুষ্ট হবে যখন খায়রুল হকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে; তখনই সন্তুষ্ট হবে যখন এই খায়রুল হকের শাস্তি দেখে বর্তমান এবং ভবিষ্যতের কোনো বিচারক খায়রুল হক হওয়ার চেষ্টা করবে না।’