সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে উত্তাল রাজধানীসহ দেশের বিভাগীয় শহরগুলো। সবশেষ গত দুইদিন ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’- এর ব্যানারে ‘বাংলা ব্লকেড’ এর ডাক দিয়ে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে অবরোধ কর্মসূচি পালনের পর আজ গণসংযোগ করছে আন্দোলনকারীরা। আগামী দিনে এ নিয়ে দেশব্যাপী আরও কঠোর আন্দোলনের ঘোষণাও দিয়েছে তারা। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের দাবির যৌক্তিকতা বিচার করে সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা সম্পূর্ণ বাতিলের পরিবর্তে সংস্কারের কথা চিন্তা করছে সরকার। তবে, এর আগে উচ্চ আদালতের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করছে সরকারপক্ষ। সেইসঙ্গে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদেরকেও আপাতত রাজপথ ছেড়ে আইনি লড়াইয়ে শামিল হতে আহ্বান জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী, যাতে সাড়াও মিলেছে শেষ পর্যন্ত।
মঙ্গলবার (৯ জুলাই) সরকারি চাকরিতে (৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড) মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিলে পক্ষভুক্ত হওয়ার জন্য আবেদন করা হয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক সমিতির সভাপতি আল সাদী ভূঁইয়া এ আবেদন করেন।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষের আইনজীবীদের একজন ব্যারিস্টার হারুনুর রশীদ জানিয়েছেন, হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে যে আবেদন করেছে, তা বিচারাধীন। এটি থাকা অবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক সমিতির সভাপতি আল সাদী ভুইয়া এবং উর্দু বিভাগের শিক্ষার্থী আহনাফ সাঈদ খান দুজন মিলে চেম্বার আদালতের অনুমতি নিয়ে একটি সিএমপি (হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে) ফাইল করছেন। এটি আজ চেম্বার আদালতে শুনানি হবে।
এদিকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন থাকলেও তাদের দাবিগুলোকে পুরোপুরি অযৌক্তিক মনে করছে না সরকার। তাই কোটাব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কারের বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে সরকারের নীতিনির্ধারনী মহলে। তবে, এজন্য আগে আদালতের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত শুনতে চায় সবাই। তাছাড়া, সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে পুঁজি করে বিএনপিসহ সুযোগসন্ধানী মহল দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিনষ্ট করতে তৎপর হয়ে উঠেছে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সার্বিক বিষয়ে আলোচনার জন্য গতকাল সোমবার দুপুরে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত ও শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী শামসুন্নাহারের সঙ্গে বৈঠক করেন দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোটা বিরোধিতার যৌক্তিকতা তুলে ধরে বৈঠকে একজন মন্ত্রী জানান, ২০১৮ সালের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ সরকার প্রথম শ্রেণির চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিল করেছিল। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা সেই পরিপত্র বহাল চাইছেন। প্রয়োজনে কমিশন গঠন করে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিও করেছেন শিক্ষার্থীরা।
ওই মন্ত্রী জানান, কোটাব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কারের বিষয়ে সরকারের ভেতরেও আলোচনা আছে। বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধা, জাতিগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধীদের কোটা আংশিক থাকতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে আপাতত শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ানো উচিত। পরে চাকরিতে কত শতাংশ কোটা রাখা যায়, তা নিয়ে আলাদা একটা কমিশন করারও চিন্তাভাবনা আছে সরকারের।
প্রসঙ্গত, সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের আন্দোলনের পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর নবম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত সরাসরি নিয়োগে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করে একটি পরিপত্র জারি করে। সেখানে বলা হয়, ৯ম গ্রেড (পূর্বতন ১ম শ্রেণি) এবং ১০ম-১৩তম গ্রেড (পূর্বতন ২য় শ্রেণি) পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধাতালিকার ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে হবে। ওই পদসমূহে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি বাতিল করা হলো।
সব মিলিয়ে তখন নারীদের জন্য বরাদ্দ ১০ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরসূরীদের জন্য বরাদ্দ ৩০ শতাংশ এবং জেলাভিত্তিক ১০ শতাংশ, উপজাতিদের জন্য বরাদ্দ ৫ শতাংশ ও প্রতিবন্ধীদের জন্য বরাদ্দ ১ শতাংশ কোটা বাতিল করা হয় ওই পরিপত্রে।
পরবর্তীতে পরিপত্রের ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও প্রজন্ম কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সভাপতি অহিদুল ইসলাম তুষারসহ সাতজন হাইকোর্টে রিট করেন। সে রিটের শুনানি নিয়ে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। সে রুল যথাযথ ঘোষণা করে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ বলে গত ৫ জুন রায় দেন হাইকোর্ট। এই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আবেদন করলে ৪ জুলাই পর্যন্ত হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে বিষয়টি আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য নির্ধারণ করেন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের চেম্বার জজ আদালত। কিন্তু ওইদিন রিটের পক্ষের আইনজীবী না থাকায় তার পক্ষে সময় চাইলে সর্বোচ্চ আদালত শুনানি ‘নট টুডে’র আদেশ দেন।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার কোটা সংস্কারের কথা চিন্তা করলেও হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগে বিশেষ কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মুহাম্মদ (এসকে) সাইফুজ্জামান জামানও। তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের রিটের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালতের ঘোষিত রায়ে সব কোটা ফিরছে বলে প্রতীয়মান হয়। তবে সব কোটা, নাকি শুধু মুক্তিযোদ্ধা কোটা ফিরছে, তা হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় পেলে বলা যাবে।
উল্লেখ্য, পরিপত্র পুনর্বহালসহ যে চার দফা দাবিতে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা, সেই দাবিগুলো হলো- (১) ২০১৮ সালে ঘোষিত সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল ও মেধাভিত্তিক নিয়োগের পরিপত্র বহাল রাখা; (২) ২০১৮ সালের পরিপত্র বহাল সাপেক্ষে কমিশন গঠন করে দ্রুত সময়ের মধ্যে সরকারি চাকরিতে (সকল গ্রেডে) অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাদ দেওয়া এবং সংবিধান অনুযায়ী শুধু অনগ্রসর ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনা করা; (৩) সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় কোটা সুবিধা একাধিকবার ব্যবহার করা যাবে না এবং কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে শূন্য পদগুলোতে মেধা অনুযায়ী নিয়োগ দেওয়া এবং (৪) দুর্নীতিমুক্ত, নিরপেক্ষ ও মেধাভিত্তিক আমলাতন্ত্র নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া।