অষ্টম পর্বের শেষে উল্লিখিত হয়েছিল, আনাতোলিয়াতে ওসমানীয় রাষ্ট্রের পাশাপাশি জার্মিয়ান, কারামান, এশরেফিদ, আয়দিন, কারেসিদ, হামিদ, মেনতেশে ও জান্দার রাষ্ট্র ছিল। এ রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে জার্মিয়ান রাষ্ট্র ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী ও বড়। তা ছাড়া আশপাশের ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলো জার্মিয়ান রাষ্ট্রের প্রধান ইয়াকুপ বের আনুগত্য করত। কারেসিদ, মেনতেশে ও আয়দিন—এ তিনটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের প্রধানেরা জার্মিয়ান রাষ্ট্রের রক্ত সম্পর্কিত ছিলেন। তাই এ তিন ক্ষুদ্র রাষ্ট্র অপেক্ষাকৃত বৃহৎ জার্মিয়ানদের আনুগত্য করত। আরও দুটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র হামিদ ও এশরেফিদ জার্মিয়ান রাষ্ট্রের আনুগত্য করত। জার্মিয়ান রাষ্ট্রের গড়া এই জোটে ব্যবসায়িক কাজের সুবাদে ছিল জান্দার রাষ্ট্রও। এ জোটের শরিকেরা জার্মিয়ান রাষ্ট্রের প্রধান ইয়াকুপ বে–কে প্রয়োজনে সৈন্য দিতে বাধ্য থাকত। তাই ইয়াকুপ বে নিজের জার্মিয়ান রাষ্ট্রের ২০ হাজার সৈন্যের পাশাপাশি জোটের মাধ্যমে অন্য রাষ্ট্র থেকে আরও ২০ হাজার সৈন্য পেতে চুক্তি করেছিলেন।
ফলে যুদ্ধাবস্থা আসন্ন হলে ইয়াকুপ বে ৪০ হাজার সৈন্য নিয়ে আক্রমণ করার মতো ক্ষমতাবান হয়েছিলেন। তবে এ জোটের বিরুদ্ধে ছিলেন ওসমান। এ জন্যই রাষ্ট্র ঘোষণার পর থেকেই জার্মিয়ানদের সঙ্গে শত্রুতা বাড়তে থাকে ওসমানের। এ শত্রুতার প্রধান কারণ ছিল ইয়াকুব বে পারস্যের মঙ্গোল ইলখানাত সাম্রাজ্যের আনুগত্য মেনে নিয়েছিলেন; যা ওসমান কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি।
অন্যদিকে আনাতোলিয়াতে কয়েকটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র জন্ম হওয়াতে মঙ্গলদের আধিপত্য কমে যাচ্ছিল বলে গাজান খান ১৩০২ সালে সেলজুক রোমের সুলতান আলাউদ্দিনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেন। ১৩০৩ সালে সেলজুক রোমের সুলতান হিসেবে পুনরায় সিংহাসনে বসেন সুলতান মাসুদ। তিনি মঙ্গোলদের তোষামোদি করতে থাকায় আনাতোলিয়ার ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোকেও মঙ্গোলদের আনুগত্য মেনে নিতে জোর প্রয়োগ করতে থাকেন। জান্দার রাষ্ট্র প্রথম থেকেই মঙ্গল ইলখানাতের আনুগত্য করত। পরবর্তী সময়ে শক্তিশালী জার্মিয়ান রাষ্ট্রের জোটও মঙ্গোলদের আনুগত্য মেনে নেয়। ওসমান ও কারামান বাদে আনাতোলিয়াতে মঙ্গোল আনুগত্য করা রাষ্ট্র ছিলই না বললে চলে।
তৎকালীন ইলখানাত সাম্রাজ্যের সম্রাটেরা ও সৈন্যরা মুসলিম হওয়া শুরু করলেও মিসরে মঙ্গোলরা নিরীহ মুসলিমদের ওপর আগ্রাসন চালাচ্ছিল। তা ছাড়া আনাতোলিয়ার কারামান রাষ্ট্রের ওপরও তারা অত্যাচার চালাতে থাকে। কারামান রাষ্ট্রে ১০-১৫ হাজার সৈন্য ছিল এবং তারা দীর্ঘকাল ধরে মঙ্গোল ও সেলজুকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আসছিল। ওসমান একে তো মঙ্গোল আধিপত্য কখনো মেনে নেয়নি, পাশাপাশি প্রয়াত সুলতান আলাউদ্দিনের মৃত্যুদণ্ডের পর ওসমান ব্যথিত হন। সেলজুক রোমের সিংহাসনে সুলতান মাসুদকে পুনরায় বসতে দেখে ওসমান সেলজুক রোমের প্রতি আর আনুগত্য না করার সিদ্ধান্ত নেন। জার্মিয়ান জোট মঙ্গোলদের আনুগত্য করাতে ওসমান এ জোটের শরিকদের সঙ্গে ব্যবসাও বন্ধ করে দেন। তা ছাড়া জার্মিয়ান প্রধান ইয়াকুপ বে ওসমানের বেশ কিছু দুর্গ ও যুদ্ধ জয়ে হিংসা পোষণও করত বলে তাদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক ছিল না।
১৩০৭ সালের দিকে ওসমানের রাষ্ট্রের পরিধি পূর্বের তুলনায় বৃদ্ধি পায় ও জনগণের সংখ্যাও আগের তুলনায় বাড়তে থাকে। এ সময় ওসমানের সদ্য জয় করা দুর্গগুলোকে ওসমানের অঞ্চলে একীভূত করে দেখা যায়, ওসমানের রাষ্ট্রে প্রায় ১ লাখের মতো জনগণ ছিল ও ৭-৮ হাজার সৈন্য ছিল। জনগণের মধ্যে খ্রিষ্টানদের সংখ্যা মুসলমানদের চেয়ে তুলনামূলকভাবে একটু বেশি ছিল। আনাতোলিয়ায় অধিকাংশ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্র আনুগত্য করলেও ওসমানীয় রাষ্ট্র মঙ্গোলদের আনুগত্য না করায় ওসমানকে শিক্ষা দিতে ইলখানাতের মঙ্গোল সম্রাট ওলিজায়তু রোমান সম্রাট আন্দ্রেনিকোসের সঙ্গে চুক্তি করতে পদক্ষেপ নেন। এ সময় রোমান সম্রাট নিজের বোন প্রিন্সেস মারিয়াকে ইলখানাতের এক বৃহৎ অঞ্চলের ক্ষমতাবান শাসক চারবান্দারের সঙ্গে বিবাহ দিতে প্রস্তাব দেন। প্রিন্সেস মারিয়া এ বিয়েতে আগে থেকেই রাজি ছিলেন। কারণ, এ বিয়ে মঙ্গোল ও রোমানদের জোট তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারত।
বলে রাখা ভালো যে প্রিন্সেস মারিয়া ছিলেন একসময়ের ইলখানাতের মঙ্গোল সম্রাট আবাকা খানের স্ত্রী। আবাকা খান ছিলেন বাগদাদ জয় করা দুর্ধর্ষ মঙ্গোল সম্রাট হালাকু খানের পুত্র। আবাকা খান সম্রাট থাকাকালীন তাঁর স্ত্রী প্রিন্সেস মারিয়া ইলখানাত সাম্রাজ্যে বেশ প্রভাবশালী ছিলেন। তাঁদের থিওডেরা নামক একজন কন্যাসন্তান ছিল। ১২৮২ সালের দিকে আবাকা খানের মৃত্যুর পর প্রিন্সেস বিধবা হয়ে নিজের কন্যাকে নিয়ে রোমান সাম্রাজ্যে ফিরে আসেন। এই বিধবা প্রিন্সেসকে এত বছর পর একজন ক্ষমতাবান মঙ্গোল গভর্নরের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল, সেটা ওসমানের বুঝতে দেরি হয়নি। এ বিয়ের মাধ্যমে মঙ্গোল ও রোমান জোট ওসমানের ভূমিকে উভয় দিক থেকে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত করবে তা ওসমান বুঝে গিয়েছিলেন। তাই ওসমান সতর্কতা অবলম্বন করতে থাকেন।
বিয়ে হওয়ার আগেই প্রিন্সেস মারিয়া ওসমানের প্রাসাদে আগমন করেন। ওসমান তাকে বেশ আপ্যায়ন করলেও প্রিন্সেস মারিয়া ওসমানকে সামনাসামনি বেশ অপমানজনক কথা বলেন। এমনকি প্রিন্সেস ওসমানের ক্ষুদ্র রাষ্ট্র ও তার বাহিনীকেও কটাক্ষ করেন। পাশাপাশি প্রিন্সেস তখন ওসমানকে রোমান ও মঙ্গোল জোটের আক্রমণে তার ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের ধ্বংস ঘনিয়ে আসার হুমকিও দেন। তবে ওসমান এ হুমকিতে কোনোভাবেই মনোবল না হারিয়ে বরং তিনি নিজের ও তার সৈন্য বাহিনীর মনোবল আরও শক্তিশালী করেন।
ওসমান নিজের সৈন্যদের একটি বাহিনী নিয়ে কয়েক দিনের মধ্যেই রোমান শহর নিকিয়ার কাছের রোমান দুর্গ ট্রিকোকায় হামলা করে তা জয় করে নেন। ওসমানের আগ্রাসনের এ অবস্থা দেখে প্রিন্সেস মারিয়াকে তৎক্ষণাৎ কনস্টান্টিনোপোলে ফিরিয়ে আনেন রোমান সম্রাট। ওসমানের এমন অতর্কিত আক্রমণে প্রিন্সেস মারিয়া ও মঙ্গোল গভর্নর চারবান্দার বিয়ে ভেঙে যায়। চলবে…
-
লেখক: তাওহীদ জানান অভিক, শিক্ষার্থী, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়