সম্প্রতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীন বিবিসি বাংলার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে যেসব কথা বলেছেন, তাতে তাঁর দৃঢ় মনোভাবই প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি চ্যালেঞ্জিং হলেও সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব। এই সাক্ষাৎকারে নতুন দলের নিবন্ধন, প্রতীক বরাদ্দ, আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকার বিষয়ও উঠে আসে। তবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও ইসির নিরপেক্ষতা।
আমরা মনে করি, একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে হলে এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সরকার তথা জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদেরও দায়িত্বশীল ভূমিকা অত্যাবশ্যকীয়। নির্বাচন কমিশনের একার পক্ষে কোনো দেশেই সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়। একটি নির্বাচন পরিচালনা করতে লাখ লাখ জনবলের প্রয়োজন হয়। কোনো নির্বাচন কমিশনের সেই জনবল থাকে না। সে ক্ষেত্রে তাদের সরকারের লোকবলের ওপরই নির্ভর করতে হয়। সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে যাঁরা যুক্ত থাকেন, তাঁদের নিরপেক্ষতা ও সততার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
যেসব দেশে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, সেসব দেশে আমলা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা শতভাগ পেশাদারি মনোভাব নিয়ে দায়িত্ব পালন করেন। অন্যদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী দল ও প্রার্থীরাও সবখানে ‘আমার লোক’ খোঁজেন না। অথচ আমাদের দেশে তাঁরা নির্বাচনের দায়িত্ব নিয়োজিত ব্যক্তিদের পক্ষে টানতে নানা অপকৌশলের আশ্রয় নেন। চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের পরও আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির খুব বেশি পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না।
এ কারণে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো আগে থেকেই নির্বাচন কমিশনের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। কমিশনের কোনো সিদ্ধান্ত পক্ষে না গেলেই যদি কোনো দল তাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন করে, তাহলে তো নির্বাচন করাটা কঠিন হয়ে পড়বে।
একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সহযোগিতা থাকতে হবে। ‘সালিস মানি কিন্তু তালগাছ আমার’ মানসিকতা পোষণ করলে নির্বাচনপ্রক্রিয়াই কেবল বাধাগ্রস্ত হবে না, গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎও অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়বে, যা কখনো কাম্য হতে পারে না। কমিশনের কোনো সিদ্ধান্ত কারও মনঃপূত না হলে তারা আইনিভাবেই বিষয়টির সুরাহা করতে পারে। ‘মানি না, মানব না’ বলে মাঠ গরম করার কৌশল পরিহার করতে হবে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, নির্বাচনের বিষয়ে তাঁরা সব প্রস্তুতি নিয়ে রাখছেন, সরকার যখনই বলবে, তঁারা নির্বাচন করতে পারবেন। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, কমিশন প্রথমে আগামী ডিসেম্বর ধরে প্রস্তুতি নিয়েছে। সরকার যখন ডিসেম্বরের সময়সীমা বাদ দিয়ে ফেব্রুয়ারি ও এপ্রিলের কথা বলছে, তখন তারা সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলছে। অতীতে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর পেছানোর অনেক নজির আছে। কিন্তু ডিসেম্বর বা জুন, ফেব্রুয়ারি বা এপ্রিল—এই দোলাচল কখনো দেখানো হয়নি। এ অবস্থায় সরকারের উচিত দেশবাসীকে ধোঁয়াশায় না রেখে নির্বাচনের সময়সীমাটি নির্দিষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়া।
সিইসির সঙ্গে আমরাও একমত যে নির্বাচনের সময়সীমা নির্ধারিত হলে উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিবেশ অনেকটা শান্ত হবে, প্রতিদ্বন্দ্বী দল ও প্রার্থীরা নিজ নিজ এলাকায় গণসংযোগেই মনোনিবেশ করবেন।
সর্বোপরি প্রধান নির্বাচন কমিশন সাক্ষাৎকারে যে দৃঢ়তা দেখিয়েছেন, দেশবাসী বাস্তবেই তার প্রতিফলন দেখতে চাইবে।