আখতার-উজ-জামান : পাকিস্তানি ষড়যন্ত্র আর দেশবিরোধী কুচক্রিমহল-এইসব উপেক্ষা করে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিব নগর সরকার গঠন করা হয় বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরে বৈদ্যনাথ তলার আম্রকাননে (পরবর্তী নাম মুজিবনগর)। তৎকালীন সময়ে মেহেরপুর অঞ্চলটি পুরোপুরিভাবে মুক্ত এলাকা হওয়ার কারণে এবং ১০ এপ্রিল এমএনএ ও এমপিদের কুষ্টিয়ায় অনুষ্ঠিত অধিবেশনে যুদ্ধ পরিচালনা ও পাক হানাদার বাহিনীকে স্বদেশ ভূমি থেকে তাড়াতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত ও নির্দেশিত পথে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনে মুজিবনগর সরকার গঠন করা হয়। আর এরই ধারাবাহিকতায় বৈদ্যনাথ তলার আমবাগানের মুজিব নগর দিবসই হলো স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম কার্যকরী সরকার। যা বাঙালি জাতির জীবনের এক অবিস্মরণীয় গৌরবগাঁথা এবং একটি ঐতিহাসিক দিন।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রত্যাশিত দিক-নির্দেশনা, সাংবিধানিক এবং যৌক্তিক অধিকার রক্ষার জন্য আজকের দিনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের কাছে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ৪৯ বছরের ইতিহাস-স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ। একটি দেশের গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করতে বাঙালি জাতি কখনো পিছু পা দেননি এবং দেবেনও না। এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে পাক হায়েনাদের কাছ থেকে একাত্তরের সাড়ে সাত কোটি বাঙালির অর্জনই ছিল আজকের সাড়ে সতেরো কোটি জাতির মূল্যবোধ। বাঙালির অনেক বছরের স্বপ্নকে বাস্তবে রুপ, জাতির জন্য একটি স্বাধীন ভূখন্ডের সৃষ্টির নামই বাংলাদেশ। নিরীহ বাংলার মানুষের ওপর ৫২ থেকে ৭১ পাক হায়েনাদের লোমহর্ষক হত্যাযজ্ঞের কথা শুনলে আজও শিহরে ওঠে নবীন, প্রবীণ আর এই প্রজন্ম। প্রতিজ্ঞা করি প্রতিষ্ঠিত আজকের বিজয়ের নিশান, যে পতাকার নিচে এখনও বাঙালি জাতিসত্ত্বার মূল লক্ষ্য মুজিব নগরের সরকার গঠনের সেই ঐতিহাসিক বৈদ্যনাথ তলার আম্রকাননের স্মৃতিচারণকে লালন করার। মুজিবনগর সরকার গঠনের প্রাক্কালে যে ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়েছিল তার ৬ষ্ঠ অনুচ্ছেদে লেখা ছিল, ‘বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি জনগণের অবিসংবাদিত নেতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বাংলাদেশের অখ-তা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলার জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান’ ঘোষণাপত্রের নবম অনুচ্ছেদে লেখা ছিল, ‘যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের ওপর তাদের কার্যকরী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করিয়াছে, সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকার বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়েছেন সেই ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আমাদের সমন্বয়ে গণপরিষদ গঠন করে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য সেহেতু আমরা বাংলাদেশকে রূপায়িত করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি এবং উহা দ্বারা পূর্বেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করছি।’ এতে আরো উল্লেখ করা হয়, ‘এতদ্বারা আমরা আরো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছি যে, শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন। রাষ্ট্রপ্রধান প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনী সমূহের সর্বাধিনায়ক পদেও অধিষ্ঠিত থাকবেন। রাষ্ট্রপ্রধানই সর্বপ্রকার প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতার অধিকারী।’
মুজিব নগর সরকার গঠনের সময় কয়েক প্লাটুন ইপিআর ও মুক্তিযোদ্ধা শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে গার্ড অব অনার প্রদান করে। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান শুরু হয় বেলা ১১টায়। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের কথা ঘোষণা করেন, অতঃপর তিনি বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যদের নাম ঘোষণা করেন এবং পরিচয় করিয়ে দেন। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভাষণ দেন এবং পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন। পূর্ব ঘোষণা মোতাবেক ১৯৭১’র ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরে বৈদ্যনাথ তলার আমবাগানে মন্ত্রিপরিষদের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। সকাল ৯ টা থেকেই সেখানে নেতৃবৃন্দ ও আমন্ত্রিত অতিথিদের আগমন শুরু হয়। দেশি বিদেশি সাংবাদিকরা ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। বেলা ১১টায় শপথ অনুষ্ঠান শুরু হয়। কুরআন তেলাওয়াত ও জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা হয় এবং শুরুতেই বাংলাদেশকে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ রূপে ঘোষণা করা হয়। এরপর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি- একে- একে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর তিন সহকর্মীকে পরিচয় করিয়ে দেন এবং নুতন রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান হিসেবে কর্নেল এম এ জি ওসমানী এবং সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ পদে কর্নেল আবদুর রবের নাম ঘোষণা করেন। এরপর সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়। এই ঘোষণাপত্র এর আগেও ১০ এপ্রিল প্রচার করা হয় এবং এর কার্যকারিতা ঘোষণা করা হয় ২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে। ঐদিন থেকে ঐ স্থানের নাম দেয়া হয় মুজিব নগর।
সদ্যসৃষ্ট রাষ্ট্রের সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতা লাভের অদম্য স্পৃহায় মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত সর্বস্তরের বিপুল সংখ্যক জনগণ ও দেশি-বিদেশি সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন। মুজিবনগর সরকার গঠন করার ফলে বিশ্ববাসী স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামরত বাঙালিদের প্রতি সমর্থন ও সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেন। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম সরকার ‘মুজিব নগর সরকার’ গঠন বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক অনন্য গৌরবগাঁথা সাফল্য। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকচক্র নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করতে না চাওয়ার কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এদেশের কৃষক-শ্রমিক জনতা, শিক্ষক, ডাক্তার, বুদ্ধিজীবী স্বাধীনতার পতাকা হাতে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য শপথ নিয়েছিল। ঠিক তখনই মুজিবনগর সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা তৎকালীন বাংলার জনগণ উপলদ্ধি করেছিল। একটা জাতির স্বাধীনতার আকাঙ্খা পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছিল কামানের মুখে। সমস্ত জাতির ভাষা যে বজ্রকণ্ঠ ধারণ করেছিল সেদিন, বিনা অপরাধে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। সারা দেশে নির্বিচারে গণহত্যা, নিরীহ মানুষদের ব্যাপকভাবে ধরপাকড় চালিয়ে পাক শাসকরা চেয়েছিল বাঙালি জাতিকে চিরদিনের মতো স্তব্ধ করে দিতে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এরই মধ্যে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। সেই ঘোষণা পরবর্তী সময়ে ছড়িয়ে দেয়া হয় সর্বত্র। সত্যিকারের স্বাধীনতার ঘোষণার প্রেক্ষাপট একদিনেই তৈরি হয়নি। এটা তৈরি হয়েছে ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ৬ দফা এবং ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান থেকে। ’৭০-এর নির্বাচন না মেনে নেয়ার প্রেক্ষিত থেকে। আর এসব পটভূমিকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই সব কিছুর অবিসংবাদিত নেতা তথা স্বাধীনতা যুদ্ধের অগ্রসেনানীরূপে প্রতীয়মান হয়। ৫৪ হাজার ৫০৬ বর্গমাইল বিস্তৃত ভৌগোলিক এলাকায় সাড়ে ৭ কোটি মানুষের জন্য আবাসিক ভূমি হিসেবে স্বাধীন ও সার্বভৌম এ রাষ্ট্রের নাম ‘বাংলাদেশ’। এই ঘোষণাপত্রে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি চালু করার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়। এর এক জায়গায় বলা হয়, ‘হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ও বাঙালি-অবাঙালি সাম্প্রদায়িক মনোভাব পরিহার করতে হবে এবং সম্প্রীতি বজায় রাখতে হবে।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি (বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি), তাজউদ্দিন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলীকে অর্থমন্ত্রী এবং এএইচএম কামারুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়। তৎকালীন কর্নেল এমএজি ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়। এই দায়িত্ব অর্পনের মধ্য দিয়ে ১০ এপ্রিল গঠিত সরকারের ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়। প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। পবিত্র কোরান তেলওয়াতের পর দেশের জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন ও নবগঠিত সরকারকে গার্ড অব অনার দেয়া হয়। পরে মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ ও প্রধান সেনাপতি কর্নেল এমএজি ওসমানী (পরবর্তীতে জেনারেল) বক্তব্য দেন। এমনিভাবেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত সংসদের নেতৃত্বে একটি সাংবিধানিক সরকার বিশ্বে আত্মপ্রকাশ করে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে একাত্তরের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নব সূচনা উদিত হয় এবং মেহেরপুর বৈদ্যনাথ তলার আম্রকাননই হোক ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবসের মূল প্রতিপাদ্য। সকল মতভেদ ভুলে গিয়ে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি ও জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং রাজশাহীতে এএইচএম কামারুজ্জামানের সমাধিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করি। তাঁদের প্রতি জানাই অফুরন্ত শ্রদ্ধা।
লেখক: গবেষক ও সাংবাদিক
e-mail : azamanrahat@gmail.com