ছাত্ররাজনীতিমুক্ত খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) গতকাল বুধবার আগের সিদ্ধান্ত বহাল রাখা হয়েছে। সেখানে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ। এক জরুরি সিন্ডিকেট সভায় উদ্ভূত পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে এই সিদ্ধান্তসহ আরো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
যেসব শিক্ষার্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, তাঁদের আজীবন বহিষ্কার ও ছাত্রত্ব বাতিলেরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এ ছাড়া ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কুয়েটের একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। তবে শিক্ষার্থীদের হলত্যাগের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত সিন্ডিকেটে হয়নি।
এদিকে হামলার ঘটনায় গত রাতে ৪০০ থেকে ৫০০ অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের খানজাহান আলী থানায় মামলাটি করা হয়।
তবে নিরাপত্তার স্বার্থে বাদীর নাম প্রকাশ করেনি কর্তৃপক্ষ।
রাত সোয়া ১০টায় এই প্রতিবেদন লেখার সময় খানজাহান আলী থানার ওসি একটি অনুষ্ঠানে থাকায় তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে কুয়েটের জনসংযোগ কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) শাহেদুজ্জামান শেখ এটি নিশ্চিত করেছেন। গতকাল সকাল সাড়ে ১১টায় কুয়েটের ৯৮তম জরুরি সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই মামলা করা হয়।
গত মঙ্গলবারের ঘটনা তদন্তে চার সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এম এ হাসেমকে সভাপতি এবং ছাত্রকল্যাণ পরিষদের সহকারী পরিচালক শাহ মুহাম্মদ আজমত উল্লাহকে সদস্যসচিব করে গঠিত কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবু ইউসুফ ও অধ্যাপক ড. আবু জাকির মোর্শেদ। তদন্ত কমিটিকে আগামী তিন কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
গতকাল সকাল ১১টা থেকে অনলাইনে এই সিন্ডিকেট সভা শুরু হয়। আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারি এই সভা হওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জরুরি ভিত্তিতে অনলাইনে এই সভা হয়। কুয়েট মেডিক্যাল সেন্টারে অবরুদ্ধ উপাচার্য (ভিসি) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাছুদ সেখান থেকেই সভায় যুক্ত হন।
রাজনীতি নিষিদ্ধ : সিন্ডিকেটের জরুরি অনলাইন সভায় কুয়েটে সব ধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। সভায় জানানো হয়, কুয়েটে গত বছর ১১ আগস্ট অনুষ্ঠিত ৯৩ নম্বর সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সব ধরনের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত বহাল থাকবে। কুয়েট আইন ২০০৩-এর ধারা ৪৪(৫) অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে সব ধরনের রাজনৈতিক সংগঠনের কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ততা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো। এ আইন অমান্যকারীর বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধান অনুযায়ী চাকরিচ্যুত করাসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এ ছাড়া রাজনীতির সঙ্গে জড়িত শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে তদন্ত সাপেক্ষে আজীবন বহিষ্কার ও ছাত্রত্ব বাতিল করা হবে।
জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলার সিদ্ধান্ত : সিন্ডিকেট সভায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবি অনুযায়ী মঙ্গলবারের হামলায় জড়িতদের বহিষ্কার, বহিরাগতের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের, আহতদের চিকিৎসা খরচসহ শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দেওয়ারও সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর আগে উপাচার্যের পদত্যাগসহ ছয় দফা দাবিতে কুয়েটের প্রশাসনিক ও একাডেমিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেন শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে সকাল থেকে অনেক শিক্ষার্থী হল ত্যাগ করতে শুরু করেন।
২৪ ঘণ্টা পর মুক্ত ভিসি : প্রায় ২৪ ঘণ্টা অবরুদ্ধ থাকার পর কুয়েট ভিসি অধ্যাপক মোহাম্মদ মাছুদ গতকাল বিকেল ৫টা ১০ মিনিটের দিকে মুক্ত হয়েছেন। মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে তিনি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় আহত হয়ে কুয়েট মেডিক্যাল সেন্টারে চিকিৎসার জন্য গেলে সেখানেই তাঁকে অবরুদ্ধ করে রাখেন শিক্ষার্থীরা। সন্ধ্যায় প্রোভিসি শেখ শরীফুল আলম এবং ছাত্রবিষয়ক পরিচালক সুলতান মাহমুদ সেখানে গেলে তাঁরাও অবরুদ্ধ থাকেন। ভিসি বের হওয়ার কয়েক মিনিট পর প্রোভিসি ও ছাত্রবিষয়ক পরিচালকও সেখান থেকে বের হন।
বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদলের বিক্ষোভ : সকালে নগরীর শিববাড়ি মোড়ে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করেন বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলসহ বিএনপির অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। তাঁরা সেখানে সংবাদমাধ্যমের সামনে বক্তব্য দিতে গিয়ে ওই ঘটনার জন্য ছাত্রশিবিরকে দায়ী করেন। পরে তাঁরা মিছিল নিয়ে খুলনা প্রেস ক্লাবের দিকে গিয়ে ছাত্রদলের সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেন।
শিবির-ছাত্রলীগের ওপর দায় ছাত্রদলের : কুয়েটে হামলার ঘটনায় ছাত্রদলের নেতারা ছাত্রশিবির ও নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের কর্মীদের দায়ী করেছেন। তাঁরা বলেন, ‘সাধারণ শিক্ষার্থী’ ব্যানারের পেছনে লুকানো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, গুপ্ত সংগঠনের ধারক-বাহক ছাত্রশিবির এবং ক্যাম্পাসে রয়ে যাওয়া ফ্যাসিবাদী নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের কর্মীরা এ ঘটনা ঘটিয়েছে।
গতকাল দুপুরে খুলনা প্রেস ক্লাবের লিয়াকত আলী মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত কুয়েট ছাত্রদলের সংবাদ সম্মেলন থেকে এসব দাবি করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য পাঠ করেন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সিনিয়র সহসভাপতি আবু আফসান মো. ইয়াহিয়া এবং সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শ্যামল মালুম।
সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রনেতারা বলেন, কুয়েটে ছাত্রদলের কোনো কমিটি নেই। শুধু সমর্থক হওয়ায় কুয়েটে প্রথমে তিনজন ছাত্র আহত হন। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়টির সম্মান কোর্সের নিয়মিত শিক্ষার্থী। তাই এ ঘটনাকে ছাত্রদলের হামলা হিসেবে প্রচার করা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এ সময় ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে কথা বলেন কুয়েট শিক্ষার্থী রাহুল জাবেদ ও ইফান জমাদ্দার।
বিএনপির বিবৃতি : খুলনা বিএনপির এক বিবৃতিতে কুয়েট ক্যাম্পাসের বাইরে ছাত্রদলের সদস্য ফরম বিতরণকালে হামলার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ, ক্ষোভ ও নিন্দা জানানো হয়েছে।
মঙ্গলবার দেওয়া বিবৃতিতে নেতারা বলেন, ছাত্রশিবির খুলনাকে উত্তপ্ত করার জন্য ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের মারাত্মক আহত করেছে, যা মোটেই সমর্থনযোগ্য নয়।
বিবৃতিদাতারা হলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুল, তথ্যবিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল, মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক শফিকুল আলম মনা প্রমুখ।
শিবিরের নিন্দা : কুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনার সঙ্গে ছাত্রশিবিরকে জড়িয়ে বিএনপির বিবৃতি এবং ছাত্রদলের সংবাদ সম্মেলনে আনীত কথিত অভিযোগের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির খুলনা মহানগর শাখার নেতারা।
ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদ সদস্য ও খুলনা মহানগর সভাপতি আরাফাত হোসেন মিলন এবং সেক্রেটারি রাকিব হাসান এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, কুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধসহ চার দফা দাবিতে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থানরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর বহিরাগত সন্ত্রাসীদের নিয়ে ছাত্রদল সশস্ত্র হামলা চালায়, যার সচিত্র প্রতিবেদন বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে।
কুয়েটে হামলার ঘটনায় ৪ দাবিতে মানববন্ধন : ঢাকার নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, কুয়েটে হামলাকারীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তারসহ চার দফা দাবি জানিয়েছে বৈষম্যবিরোধী প্রকৌশলী পরিষদ। এসব দাবি বাস্তবায়নে ৭২ ঘণ্টার সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বৈষম্যবিরোধী প্রকৌশলী পরিষদ আয়োজিত এক মানববন্ধনে বক্তারা এসব দাবি জানান।
দাবিগুলো হলো ৭২ ঘণ্টার মধ্যে হামলাকারীদের গ্রেপ্তার এবং ভিডিও ফুটেজ দেখে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করতে হবে; বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা ও ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে; লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের ব্যাপারে জনমতের ভিত্তিতে প্রণীত আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকাসহ ক্যাম্পাসে লেখাপড়ার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
মানববন্ধনে উপস্থিত ছিলেন বৈষম্যবিরোধী প্রকৌশলী পরিষদের মুখপাত্র প্রকৌশলী আলী আম্মার মোয়াজ, মুখ্য সমন্বয়ক প্রকৌশলী মাহমুদুর রহমান প্রমুখ।
সূত্র: কালেরকণ্ঠ