গাজায় ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র–সমর্থিত বিতর্কিত ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রের সাবেক এক নিরাপত্তাকর্মী বলেন, তিনি একাধিকবার এসব কেন্দ্রে ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের ওপর গুলি চালাতে দেখেছেন। ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রের নিরাপত্তাকর্মীরা নিরীহ ফিলিস্তিনিদের ওপর মেশিনগানসহ বিভিন্ন অস্ত্র থেকে গুলি চালিয়েছেন।
বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ) সাবেক এ কর্মী আরও বলেন, একবার নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের একটি দল ত্রাণকেন্দ্র থেকে সরতে দেরি করছিল দেখে এক নিরাপত্তাকর্মী একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার থেকে মেশিনগান দিয়ে গুলি চালিয়েছিলেন।
তবে জিএইচএফ দাবি করেছে, এসব অভিযোগ একেবারেই মিথ্যা।
এক বিবৃতিতে তারা বলেছে, তাদের ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রে কখনো কোনো বেসামরিক মানুষকে গুলি করা হয়নি।
জিএইচএফ গত মে মাসের শেষ দিকে গাজায় তাদের কার্যক্রম শুরু করে। দক্ষিণ ও মধ্য গাজার কয়েকটি কেন্দ্র থেকে সীমিত পরিমাণে ত্রাণ বিতরণ করা হয়। এর আগে ইসরায়েল টানা ১১ সপ্তাহ গাজা পুরোপুরি অবরোধ করে রেখেছিল। এর ফলে সেখানে কোনো খাবার ঢুকতে পারেনি।
তবে জিএইচএফের এ বিতরণব্যবস্থা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। কারণ, এ ব্যবস্থার আওতায় হাজার হাজার মানুষকে সক্রিয় যুদ্ধক্ষেত্র পেরিয়ে হাতেগোনা কয়েকটি কেন্দ্রে যেতে বাধ্য করা হয়। জাতিসংঘ ও স্থানীয় চিকিৎসকদের তথ্য বলছে, জিএইচএফ কার্যক্রম শুরু করার পর থেকে ত্রাণ নিতে যাওয়ার সময় ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে ছয় শর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
ইসরায়েল দাবি করছে, নতুন এই বিতরণব্যবস্থা চালুর ফলে গাজার সশস্ত্র সংগঠন হামাসের হাতে ত্রাণ পৌঁছানো বন্ধ হয়েছে।
বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জিএইচএফের একটি ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রের ঘটনা বর্ণনা করেন সাবেক ওই নিরাপত্তা কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ঘটনার সময় অন্য একজন নিরাপত্তাকর্মী বিতরণকেন্দ্র থেকে বের হওয়ার পথের পাশে উঁচু একটি জায়গা থেকে নজরদারি করছিলেন। ওই নিরাপত্তাকর্মীই ভিড় লক্ষ্য করে টানা ১৫ থেকে ২০টি গুলি চালান। এতে একজন ফিলিস্তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তিনি নড়াচড়া করছিলেন না।
ওই সময় পাশে থাকা আরেকজন নিরাপত্তাকর্মী বলে ওঠেন, ‘আরে দেখ, মনে হয় একজনকে নিশানা করে ফেলেছ।’ এরপর তাঁরা এ নিয়ে হাসাহাসি করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই নিরাপত্তা কর্মকর্তা বিবিসিকে আরও বলেন, ঘটনাটির কথা ব্যবস্থাপকদের জানানো হয়েছিল। তবে তাঁরা বিষয়টিকে গুরুত্ব দেননি। তাঁরা বলছিলেন, ‘লোকটা হয়তো হোঁচট খেয়ে পড়েছে বা ক্লান্ত হয়ে লুটিয়ে পড়েছে।’
তবে বিবিসিকে সাক্ষাৎকার দেওয়া সাবেক ওই নিরাপত্তাকর্মীকে নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছে জিএইচএফ। তারা বলেছে, ওই অভিযোগকারী কর্মী খারাপ আচরণের জন্য চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন।
জিএইচএফের ত্রাণ বিতরণের ব্যবস্থা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। জাতিসংঘ ও স্থানীয় চিকিৎসকদের তথ্য বলছে, জিএইচএফ কার্যক্রম শুরু করার পর থেকে ত্রাণ নিতে যাওয়ার সময় ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে চার শর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
তবে সাবেক ওই কর্মী বলেন, এ অভিযোগ মিথ্যা। তিনি বিবিসিকে বেতনের রসিদ দেখিয়েছেন। এতে দেখা যায়, চাকরি ছাড়ার পরও আরও দুই সপ্তাহ তাঁকে টাকা দেওয়া হয়েছে।
ওই ব্যক্তি বলেন, তিনি জিএইচএফের চারটি ত্রাণকেন্দ্রের সব কটিতেই কাজ করেছেন। তাঁর ভাষায়, সেখানে যেন কোনো নিয়মই নেই—কে কী করছে তা দেখার কেউ নেই, ভুল করলেও কোনো শাস্তি হয় না।
ওই কর্মী আরও বলেন, ওই প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তাকর্মীরা কীভাবে কাজ করবেন তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো নিয়মকানুন ছিল না। ত্রাণ সংস্থার এক দলনেতা কর্মীদের বলেছিলেন, ‘নিজেকে হুমকির মধ্যে মনে করলে গুলি করো—মেরে ফেলো, কথাবার্তা পরে হবে।’
ওই কর্মকর্তার বক্তব্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানের ভেতরের পরিবেশ ছিল এমন যে ‘আমরা গাজায় যাচ্ছি, সুতরাং এখানে কোনো নিয়ম নেই। যা খুশি তা–ই করো।’
জিএইচএফ–এর ওই সাবেক কর্মী বলেন, নিরাপত্তাকর্মীদের দলীয় নেতারা গাজার মানুষদের ‘জম্বির ঝাঁক’ বলে ডাকতেন। এর মধ্য দিয়ে বোঝানো হতো, এ মানুষগুলোর কোনো মূল্যই নেই।
উল্লিখিত কর্মী আরও বলেন, ‘যদি এমন হয় যে কোনো ফিলিস্তিনি শত্রুতাপূর্ণ কোনো আচরণ না দেখিয়েই ত্রাণকেন্দ্র থেকে চলে যাচ্ছেন এবং এর পরও যদি আমরা তাকে লক্ষ্য করে সতর্কতামূলক গুলি ছুড়ি, তাহলে আমরা ভুল করছি, এটা অপরাধ। এর দায় এড়ানো যায় না।’
ওই কর্মকর্তার তথ্য অনুসারে, এলাকার সবকিছু নজরদারির জন্য প্রতিটি ত্রাণকেন্দ্রে সিসিটিভি ছিল। তাই তিনি মনে করেন, জিএইচএফ যদি বলে কেউ আহত বা গুলিবিদ্ধ হননি, তাহলে সেটা একেবারে নির্লজ্জ মিথ্যা। জিএইচএফ বলেছে, বিবিসিকে দেওয়া ভিডিওতে যে গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে, সেটি ইসরায়েলি বাহিনীর গুলি।
ওই সাবেক কর্মী বলেন, নিরাপত্তাকর্মীদের দলীয় নেতারা গাজার মানুষদের ‘জম্বির ঝাঁক’ বলে ডাকতেন। এর মধ্য দিয়ে বোঝানো হতো, এই মানুষগুলোর কোনো মূল্যই নেই।
উল্লিখিত ব্যক্তি আরও বলেন, জিএইচএফের ত্রাণকেন্দ্রগুলোতে ফিলিস্তিনিরা শুধু গুলিতেই নয়, আরও নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। যেমন কেউ স্টান গ্রেনেডের ধ্বংসাবশেষের আঘাতে আহত হচ্ছেন, কাউকে মুখে স্প্রে করা হচ্ছে, আবার কেউ ভিড়ের চাপ ঠেলে রেজার তারে পড়ে জখম হচ্ছেন।
ওই নিরাপত্তাকর্মী নিজের চোখে এমন কিছু ঘটনা দেখেছেন। যেমন এক ব্যক্তির মুখে পুরো একটি পেপার স্প্রে ক্যান ছুড়ে মারা হয়। আরেক নারী স্টান গ্রেনেডের ধাতব অংশের আঘাতে মাথায় আঘাত পান। ওই স্টান গ্রেনেডটি জনতার ভিড়ের মধ্যে যথাযথভাবে ছোড়া হয়নি।
সাবেক ওই কর্মী বলেন, ‘ওই ধাতব টুকরাটা সরাসরি তাঁর মাথায় লেগেছিল। তিনি সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে পড়ে যান, নড়াচড়া করছিলেন না। মারা গেছেন কিনা জানি না; কিন্তু নিশ্চিত জানি, তিনি অচেতন ছিলেন, পুরো নিস্তেজ হয়ে গিয়েছিলেন।
এ ঘটনার কিছুদিন পরই অক্সফাম ও সেভ দ্য চিলড্রেনসহ ১৭০টির বেশি আন্তর্জাতিক দাতব্য ও বেসরকারি সংস্থা একযোগে জিএইচএফের কার্যক্রম বন্ধ করার দাবি জানায়। ইসরায়েলি বাহিনী ও সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো নিয়মিতভাবেই ত্রাণ নিতে আসা ফিলিস্তিনিদের ওপর গুলি চালায়।
ইসরায়েল দাবি করছে, তাদের সেনারা ইচ্ছাকৃতভাবে ত্রাণ নিতে আসা মানুষদের ওপর গুলি চালান না। তারা দাবি করেছে, জিএইচএফের ত্রাণব্যবস্থার আওতায় ত্রাণের অভাবে থাকা মানুষদের সরাসরি সহায়তা দেওয়া হয়। এতে হামাসের হস্তক্ষেপ এড়ানো যায়।
জিএইচএফের দাবি, তারা মাত্র পাঁচ সপ্তাহে ৫ কোটি ২০ লাখের বেশি খাবারের প্যাকেট বিতরণ করেছে। তাদের দাবি, অন্য অনেক সংস্থার কর্মীরা অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থেকে তাদের ত্রাণ লুটপাট হওয়ার দৃশ্য দেখেছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাস হামলা চালায়। ওই হামলায় প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত হন এবং ২৫১ জনকে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয়। জবাবে সেদিন থেকেই ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গাজায় নির্বিচার ও নৃশংস হামলা শুরু করে।
গাজার হামাসনিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এরপর থেকে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত অন্তত ৫৭ হাজার ১৩০ জন নিহত হয়েছেন।