আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন (ইসি) গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) বেশ কিছু সংশোধনী প্রস্তাব করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আদালত কর্তৃক পলাতক ঘোষিত আসামিদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা, অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার বিধান বাদ দেওয়া, সেনাবাহিনীকে ভোটকেন্দ্রে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া এবং প্রার্থীর সম্পদ ও আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার শর্ত আরও কঠোর করা। এসব প্রস্তাবে নির্বাচনী আইনকে যুগোপযোগী করার উদ্যোগ যেমন আছে, তেমনি এসব বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কিছু ঝুঁকির দিককেও উপেক্ষা করা যাচ্ছে না।
পলাতক আসামিকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার বিধান নীতিগতভাবে যৌক্তিক। একজন আইন ভঙ্গকারী ও আদালতের অধীনস্থ হতে অস্বীকৃত ব্যক্তি জনগণের প্রতিনিধি হওয়ার যোগ্য হতে পারেন না। তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় খুব সহজেই এ বিধানের অপব্যবহারের সুযোগ রয়ে গেছে।
বাংলাদেশে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার দৃষ্টান্ত রয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা দিয়ে তাঁকে আদালতে হাজির হতে বাধা সৃষ্টি করা হলে পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠতে পারে। আদালতের মাধ্যমে পলাতক ঘোষণার প্রক্রিয়া যথেষ্ট স্বচ্ছ না হলে এটি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার হাতিয়ার হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই এ ক্ষেত্রে সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা থাকা অপরিহার্য।
প্রার্থীদের দেশে-বিদেশের সম্পদের হিসাব, আয়কর রিটার্ন ও হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দিলে প্রার্থিতা বাতিলের প্রস্তাব স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে জনগণের প্রতিনিধি হওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতা যাচাইয়ের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এসব বিধান প্রয়োগে নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষতা ও দৃঢ়তা দেখাতে হবে।
সশস্ত্র বাহিনীকে সংজ্ঞাভুক্ত করে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। অতীতে সেনা মোতায়েন নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে সহায়ক ছিল। কিন্তু বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারের মতো ক্ষমতা দেওয়ার ক্ষেত্রে তার সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। এটি যেন নির্বাচনের পরিবেশকে কোনোভাবে সন্ত্রস্ত না করে, সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। নির্বাচনী জামানত বৃদ্ধি, ব্যয়ের সীমা নির্ধারণ, অনুদান নেওয়ার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আনাসহ প্রস্তাবগুলোর ইতিবাচক দিক আছে। তবে এগুলো যেন প্রার্থীদের আর্থিকভাবে অযথা চাপ না সৃষ্টি করে, সে বিষয়েও নজর দেওয়া জরুরি।
মনোনয়নপত্র অনলাইনে জমা দেওয়ার বিধান বাদ দেওয়ার প্রস্তাব কতটা যৌক্তিক—সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে যেকোনো প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও সহজ করা সম্ভব হয়। তাই ডিজিটাল ব্যবস্থা শক্তিশালী করে অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার বিষয়টি বহাল থাকলে ভালো হতো। অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার বিধান বাদ দেওয়ার বিষয়টি নির্বাচনী প্রক্রিয়ার আধুনিকীকরণের পথে একটি পশ্চাৎপদ সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
সাংবাদিকদের ভূমিকা সীমিত করার প্রস্তাবটিতে উদ্বেগ তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে ভোটকক্ষে সাংবাদিকদের অবস্থান নির্ধারণের ক্ষমতা দেওয়া হলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ব্যাহত হতে পারে। নির্বাচন পর্যবেক্ষণে সাংবাদিকেরা কেবল সহায়ক নয়, গণতান্ত্রিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার অন্যতম মাধ্যম। ফলে কারও কারও কাছে এ প্রস্তাবকে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের এক প্রচ্ছন্ন বার্তা বলে প্রতীয়মান হতে পারে। নির্বাচন কমিশনের এই প্রস্তাব পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন।
নির্বাচন কমিশন বলছে, তারা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করেছে। আরপিও সংশোধনের প্রস্তাবে রাজনৈতিক ঐকমত্যও জরুরি। সর্বোপরি গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধনে ইসির প্রস্তাবগুলোতে ইতিবাচক দিক যেমন আছে, তেমনি কিছু ক্ষেত্রে প্রশ্নও রয়েছে। নির্বাচন হতে হবে এমন একটি প্রক্রিয়ায়, যেখানে প্রার্থীর যোগ্যতা যাচাইয়ের পাশাপাশি প্রত্যেক নাগরিক নিশ্চিন্তে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন। আরপিও সংশোধন যেন কোনোভাবেই রাজনৈতিক প্রতিযোগিতাকে সীমিত করার কাজে ব্যবহৃত না হয়; বরং তা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।