অফুরন্ত ভালোবাসা : কাজী সুলতানুল আরেফিন
কলিজার বাঁধন ছিন্ন করে আমি যেতে চাই না। অফুরন্ত ভালোবাসার শক্তিকে কী কেউ আজ পর্যন্ত দমাতে পেরেছিল? হয়তো কিছুকাল থামাতে পেরেছিল। কালে কালে আবারো বীজ থেকে জন্ম নেয় অফুরন্ত ভালোবাসার বট বৃক্ষ।
আমার বিবাহের আগে আমার শ্বশুর মারা গেছেন। সে সুবাদে আমার সন্তানদের ‘নানা’ নেই। আমার স্ত্রীর কোন ভাই নেই। সে সুবাদে আমার সন্তানদের ‘মামাও’ নেই। আমার সন্তানেরা কিছু আদর থেকে বঞ্চিত। তাই আমি ওদের খুব আদর করি। খুব ভালোবাসি। তাদের মত আমারও এখন আর কেউ নেই বললেই চলে! আপনজনেরা স্বার্থ সিদ্ধির জন্য আমাকে একা করে দিয়েছে। আমার সন্তানেরাও আমাকে খুব ভালোবাসে। এ যেন কোন অফুরন্ত ভালোবাসা! আমি যখন বাসা থেকে কোন কাজে বের হতে যাই তখন তারা আমাকে পেছন থেকে খামচি মেরে ধরে রাখে। তাদের কাছে আগলে রাখতে চায়। কান্নাকাটি শুরু করে। আমি তখন আল্লাহ্কে বলি, ‘ওদের জন্য হলেও আমাকে নিরাপদে আবার ফিরিয়ে এনো’।
আমি যখন বের হয়ে চলে যাই তখন থেকে জানালার কাছে রাস্তার পানে তাকিয়ে ঠায় দাড়িয়ে থাকে। দরজার কাছে এসে ঘুরাঘুরি করে আমার আসার অপেক্ষায়। আমি যখন ফিরে আসি, আমার মোটর সাইকেলের শব্দ শুনে বাসায় খুশিতে নাচানাচি শুরু করে। আমি যখন বাসায় প্রবেশ করি তখন তারা ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে।
এই বয়সে শরীরে অনেক অসুখ বাসা বেঁধেছে। আমার প্রতি তাদের ভালোবাসা দেখে আল্লাহ্কে আবারো বলি, ‘ওদের জন্য হলেও আমাকে বাঁচিয়ে রাখো’। মাঝে মাঝে নিজেকে প্রশ্ন করি, ‘তারা আমাকে এমন ভালোবাসে কেন? তারা কী বুঝতে পেরেছে? আমার বিদায় যে সন্নিকটে!’
দিন দিন শরীর খুব খারাপ থেকে খারাপ হতে লাগলো। দু-তিনবার হাসপাতালে কাটাতে হয়েছে কয়েক রাত। ডাক্তার বড় বড় টেস্ট দিয়েছেন। ঢাকা থেকে টেস্ট করিয়েছি। যাতে রিপোর্ট ঠিক মত আসে। সাধারণত এখনকার সময়ের ডাক্তারেরা রোগীকে কোন খারাপ খবর এখন সরাসরি দিতে চান না! ডাক্তারের সাথে সখ্যতার কারণে আমি ডাক্তারকে নিঃসঙ্কোচে বলতে বললাম। ডাক্তার মাথা নিচু করে জানালেন, ‘সময় বোধহয় বেশি নেই’! আমি বসা থেকে উঠে ডাক্তারকে ধমকের সুরে বললাম, ‘বললেই হল? আমার সন্তানেরা আমাকে যেতে দিলে তো?’
ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে আজ আর রিকশায় উঠলাম না। হাঁটা ধরলাম। সন্ধ্যার আকাশে পূর্ণিমার চাঁদটা আজ আরও বড় দেখাচ্ছে। চাঁদের দিকেই তাকিয়ে হাঁটছিলাম। ঝিরি ঝিরি মৃদু বাতাসেরা আমার মুখে হামলে পড়ছিল। বুকের এক পাশে খুব ব্যাথা অনুভব করলাম। বুঝতে পারলাম এ ব্যাথা আপনজন নামক মানুষদের এক এক করে দেয়া সব আঘাতের সমষ্টি। চোখের সামনে সব কিছু ঝাপসা দেখতে পেলাম। তবুও হাঁটতে লাগলাম। বাসায় আমাকে দ্রুত পৌঁছাতে হবেই। আমার সন্তানেরা রাস্তার পানে আমার পথ চেয়ে রয়েছে। আমার অফুরন্ত ভালোবাসার পাওয়ার প্রতিক্ষায় পথ চেয়ে আছে।