জানা অজানা ডেস্ক, এইউজেডনিউজ২৪: করোনা ভাইরাস নিয়ে যেসব ভুল পরামর্শ দ্রুত বিস্তার ঘটেছে, তা কতটা বিজ্ঞানসম্মত তা যাচাই করে প্রতিবেদন তৈরি করেছে বিবিসি। বিশ্বব্যাপী মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাস চীন থেকে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বজুড়ে। যে রোগের কোনো প্রতিষেধক এখনো পাওয়া যায়নি। আর এই সুযোগে এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুল কিছু পরামর্শ ভাইরাল হয়েছে। আতঙ্কিত মানুষের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে এসব পরামর্শ প্রচার করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, লোকজন তা নিয়মিত সেসব ভুল পরামর্শ শেয়ার করছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
রসুন
করোনা ভাইরাস সংক্রমণরোধে রসুন খাওয়ার পরামর্শ সম্বলিত বহু পোস্ট ফেসবুকে শেয়ার করতে দেখা যাচ্ছে। বলা হচ্ছে, করোনারোধে তা সহায়ক। কিন্তু এই বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে ভিন্ন কথা।
সংস্থাটি বলছে, স্বাস্থ্যকর খাদ্য হিসেবে রসুনে কিছু অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল বৈশিষ্ট্য থাকতেই পারে। কিন্তু এটি খেলে যে করোনা ভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে, এমন কোনো প্রমাণ বিজ্ঞানীরা পাননি।
অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল এমন একটি বিষয় যা অণুজীবকে হত্যা করে বা তাদের বৃদ্ধি বন্ধ করে। অনেক ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রতিকারমূলক পরামর্শ ক্ষতিকারক নয়, যতোক্ষণ না তারা প্রমাণ ভিত্তিক চিকিৎসা পরামর্শ অনুসরণ করা থেকে বিরত রাখছে।
সম্প্রতি সাউথ চায়না মর্নিং এমন একজন নারীর গল্পের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যিনি দেড় কেজি কাঁচা রসুন খাওয়ার পর গুরুতরভাবে ফুলে যাওয়া গলার চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তার মানে রসুন যে কতোটা এই রোগ প্রতিরোধে কার্যকর তা বলা অনিশ্চিত।
স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, সাধারণত আমরা জানি, ফলমূল এবং শাকসবজি খাওয়া এবং নিয়মিত পানি পান করা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। তবে নির্দিষ্ট খাবারগুলি এই বিশেষ ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সহায়তা করে কিনা তার কোনো প্রমাণ নেই।
অলৌকিক খনিজ
ইউটিউবার জর্ডান শাথের, যার বিভিন্ন প্লাটফর্মে রয়েছে হাজার হাজার ফলোয়ার। তিনি এবং তার ফলোয়ারদের দাবি, এমএমএস নামে এমন একটি ‘অলৌকিক খনিজ পরিপূরক’ রয়েছে, যা করোনা ভাইরাস নিশ্চিহ্ন করতে সহায়ক। যেটিতে ‘ক্লোরিন ডাই অক্সাইড’ নামের প্রতিষেধক রয়েছে।
শাথের এবং অন্যান্যরা করোনা ভাইরাস দেখা দেওয়ার আগেই এই খনিজ পদার্থটির বিজ্ঞাপন করেছিলেন। এরপর জানুয়ারিতে তিনি টুইট করে বলেন, ‘ক্লোরিন ডাই অক্সাইড’ বা ‘এমএমএস’ শুধুমাত্র করোনা ভাইরাসকেই নিশ্চিহ্ন করে না, এটি ক্যান্সার সেলকেও ধ্বংস করতে পারে।
কিন্তু আমেরিকার ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডি) কর্তৃপক্ষ এই এমএমএস সেবনের বিষয়ে স্বাস্থ্য সতর্কতা দিয়েছে। অন্যান্য দেশের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষও এই বিষয়ে সতর্কতা জারি করেছে।
এফডিএ জানায়, কোনো প্রকারের রোগের চিকিৎসার জন্য এটি কার্যকর কিনা তা কোনো গবেষণা দ্বারা প্রমাণিত নয়।
প্রতিষ্ঠানটি এই বিষয়ে সতর্ক করে বলছে, এগুলো সেবন করার কারণে শরীরে বমি বমি ভাব, ডায়রিয়া এবং মারাত্মক পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে।
ঘরে তৈরি হ্যান্ড স্যানিটাইজার
হ্যান্ড স্যানিটাইজার সংকট বিষয়ে অসংখ্য প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। বহু পোস্ট ভাইরাল হচ্ছে। কেননা, ভাইরাসটির বিস্তাররোধের জন্য হাত ধোয়া একটি মূল উপায় হিসেবে দেখা হয়। ইতালিতে এই সংকট দেখা দেওয়ার সংবাদ প্রকাশের সাথে সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘরে বসে এই জেল তৈরির উপাদানের অসংখ্য বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয়।কিস্তু অভিযোগ আছে, এই উপাদানগুলো একটি দেশের জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের প্রতারণায় জড়িত।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, এটি ত্বকে ব্যবহারে জন্য উপযুক্ত নয়।
লন্ডন স্কুল অফ হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিকাল মেডিসিনের অধ্যাপক শ্যালি ব্লুমফিল্ড বিশ্বাস করেন না যে, ঘরে বসে স্যানিটাইজিংয়ের জন্য কার্যকর কোনো পণ্য তৈরি করা সম্ভব।
পানযোগ্য রৌপ্য
মার্কিন টেলিভিশনবিদ জিম বাকারের একটি শো’তে আঠালো রৌপ্য ব্যবহারের বিষয়ে তথ্য প্রচার হয়। আঠালো রৌপ্য হচ্ছে তরল স্থগিত ক্ষুদ্রকণা।তার এই শোতে একজন অতিথি দাবি করেন, ১২ ঘণ্টার মধ্যে করোনা ভাইরাসের কিছু প্রজাতি বিনাশ করতে সক্ষম এটি। যা করোনা ভাইরাসের কাযকর চিকিৎসা হতে পারে এমন ধারণা ফেসবুকে ব্যাপকভাবে শেয়ার হয়, বিশেষ করে ‘মেডিকেল স্বাধীনতা’ গোষ্ঠীগুলো, যারা মূল ধারার চিকিৎসা পরামর্শ নিয়ে গভীরভাবে সন্দিহান।
এই পক্ষের সমর্থকরা দাবি করছেন যে, এটি সর্বপ্রকারের চিকিৎসার জন্য উপযোগী জীবাণুনাশক এবং রোগ প্রতিরোধে প্রতিষেধক হিসেবে সহায়ক।
তবে মার্কিন স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের সুস্পষ্ট পরামর্শ রয়েছে এই বিষয়ে। তারা বলছে, কোনো ধরনের স্বাস্থ্যের জন্য এই ধরনের রৌপ্য কার্যকর হওয়ার প্রমাণ নেই। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে, এটি কিডনির ক্ষতি, খিঁচুনি এবং আরজিরিয়াসহ গুরুতর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে, এমনকি এটি আপনার ত্বককে নীল করে তুলতে পারে।
তারা বলছেন যে, আয়রণ এবং জিঙ্কের বিপরীতে রৌপ্য এমন কোনো ধাতু নয়, যা মানুষের দেহে কোনো কার্যকরী থাকে।
প্রতি ১৫ মিনিটে সুপেয় পানি পান
একজন জাপানি ডাক্তারকে উদ্বৃত করে একটি পোস্ট ফেসবুকে বহুবার কপি ও শেয়ার করা হয়েছে। যেখানে মুখের মধ্যে লেগে থাকে এমন ভাইরাস লুপ্ত হয়ে যাওয়ার জন্য প্রতি ১৫ মিনিট পর সুপীয় পানি পান করার পরামর্শ দিয়েছেন।
আরবি ভাষায় এমন একটি পোষ্ট আড়াই লাখের বেশি শেয়ার হয়েছে। কিন্তু অধ্যাপক ব্লুমফিল্ড বলছেন, এটির পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই। শ্বাস প্রশ্বাসের ফলে শ্বাসনালীর মাধ্যমে এই ভাইরাস বায়ুবাহিত হয়ে শরীরে প্রবেশ করে। কিছু কিছু বিষয় হয়তো আপনার মুখের মাধ্যমে যেতে পারে, কিন্তু নিরবিচ্ছিন্নভাবে পানি পান করার মাধ্যমে এই ভাইরাস প্রতিরোধ করা যাবে না। তবুও শরীরের পাণিশূন্যতারোধে নিয়মিত পানি পান করা সাধারণত যেকোনো ভালো চিকিৎসার পরামর্শ হয়ে থাকে।
গরম পানি খাওয়া এবং আইসক্রিম এড়িয়ে চলা
করোনা থেকে মুক্ত থাকতে বা করোনা বিনাশে গরম পানি পানের পরামর্শ থেকে শুরু করে গরম পানিতে স্নান করা বা হেয়ারড্রায়ারস ব্যবহার করা সহ বৈচিত্রপূর্ণ পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। ইউনিসেফকে উদ্বৃত করে বিভিন্ন দেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি পোস্ট ব্যাপক প্রচার পেয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, গরম পানি পান করা এবং সূর্যের সংস্পর্শে এসে করোনা ভাইরাসকে প্রতিরোধ করা যায় এবং আইসক্রিম এড়িয়ে চলা উচিত।
তবে শার্লোট গর্নিটজকা, যিনি করোনা ভাইরাস নিয়ে ভুল তথ্য প্রচার বিষয়ে সতর্ক দেন, তিনি বলেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে একটি ভুল অনলাইন বার্তা ইউনিসেফ এর নামে ছড়িয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে আইসক্রিম এবং অন্যান্য ঠাণ্ডা খাবার এড়িয়ে চললে রোগের সূত্রপাত রোধে সহায়তা করে। এটি অবশ্যই ও সম্পূর্ণ অসত্য তথ্য। ইউনিসেফ এধরনের কোনো তথ্য প্রচার করেনি। আমরা জানি যে, ফ্লু ভাইরাস গ্রীষ্মের সময় শরীরের বাইরে ভালোভাবে বাঁচে না। তবে উত্তাপ বা তাপ করোনা ভাইরাসকে কীভাবে প্রভাবিত করে সে বিষয়ে এখনো আমরা জানি না।
অধ্যাপক ব্লুমফিল্ডের মতে, দেহকে উত্তপ্ত করার চেষ্টা বা নিজেকে সূর্যের সামনে প্রকাশ করার চেষ্টা মাধ্যমে ভাইরাস প্রতিরোধের চেষ্টা সম্ভবত সম্পূর্ণ অকার্যকর চেষ্টা। ভাইরাসটি একবার শরীরে প্রবেশ করলে নাশ করার কোনো উপায় নেই- আপনার দেহ কেবল এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে।
শরীরের বাইরে, সক্রিয়ভাবে ভাইরাসটিকে নাশ করার জন্য আপনার প্রায় ৬০ ডিগ্রি তাপমাত্রার প্রয়োজন হয়’। ৬০ ডিগ্রির তাপে যেকোনো তোয়ালে বা কাপড় ধোয়া একটি ভালো ধারণা বটে। এটি কাপড়ের ভাইরাসে রোধ করতে পারে। কিন্তু এটি আপনার ত্বক ধোয়ার পক্ষে ভালো বিকল্প নয় এবং গরম স্নান করা বা গরম তরল কিছু পান করা আপনার দেহের প্রকৃত তাপমাত্রাকে পরিবর্তন করবে না, যেতোটা আপনি অসুস্থ না হলে স্থিতিশীল থাকে।