সাহিত্য ও সংস্কৃতি ডেস্ক, এইউজেডনিউজ২৪: তাহমিনা মেরী, অনার্স তৃতীয় বর্ষ, কবি নজরুল কলেজ, আলী হুসাইন, ১ম বর্ষ, অনার্স, বোরহান উদ্দিন কলেজের মাস্টার্সের ছাত্রী মেঘলা, গ্রাফিক্স আর্ট কলেজের সম্ভাবনাময় তরুন আলামিন, ঢাকা পলিটেকনিকের কম্পিউটার সায়েন্সের ছাত্র ফয়সাল, গাইবান্ধা সরকারী কলেজের অনার্সের ২য় বর্ষের ছাত্রী মিম, গাইবান্ধার এইচএসসি পরীক্ষার্থী মেহেদী হাসান পেশায় এরা সবাই ছাত্র/ছাত্রী, বয়সে তরুন। এদের সবারই কমন প্লার্ট ফর্ম জুম বাংলাদেশ।
কেউ বাবা-মা বা আত্মীয় স্বজনের সাথে বাসায় থাকে, কেউবা হোস্টেল বা মেসে, কিন্তু দিনে একবার না একবার এরা ঢু মারে জুমের আঙ্গিনায়, কখনো শিক্ষক, কখনো সংগঠক, কখনো ত্রান কর্মী কখনো বা অন্য কোন পরিচয়ে। যেমন গতকাল শুক্রবার ওরা সবাই রাঁধুনী হয়েছিল।
করোনা দুর্যোগ মোকাবেলায় নিরন্ন মানুষকে রান্না করা খাবার সরবরাহ করে যাচ্ছে জুম বাংলাদেশ। প্রতিদিনই জুমের কর্মীরা বাজার, রান্না, পরিবহন, বিতরন সবই নিজেরা করে। রান্নার জন্য জুমের নিজস্ব কিছু লোক আছে। ভলান্টিয়াররা মূলতঃ পরিবহন বা বিতরন করে থাকে। এত কিছু করেও ওদের মনে হয় মন ভরছিল না, বাকী ছিল রান্না করা।
জুমের পক্ষে যে খালা রান্না করেন, তাকে হটিয়ে মেঘলা, মেরী, সুমাইয়ারা রান্নার দায়ীত্ব নিল। আলী হুসাইন, গালিব, আলামিন, ফয়সালরা নিল যোগানির দায়ীত্ব। এদের নিউক্লিয়াস হিসাবে বরাবরের মতই ছিল শাহীন,রাজীব।
বিজ্ঞ জনেরা প্রায়ই আমাদের তরুনদের মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং কমিটমেন্টের অভাব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। লজিক নাই সে কথা বলিনা।কিন্তু কাজ করার প্লাটফর্মই বা আমরা কতটুকু তৈরী করতে পারছি?
সুমাইয়া, মেঘলা, মেরী, ফয়সাল, গালিব, আলামিনের মত কয়েকশ তরুন ভলান্টিয়াররাই জুমের ৫টি স্কুল চালায়, যার ছাত্র ছাত্রীরা সকলেই চরম দরিদ্র পথ শিশু বা বস্তিবাসীদের সন্তান।
এদের পড়াশুনা, দৈনিক একবেলা খাবার, স্যোশালাইজেশন, জাতীয় চেতনার বিকাশ এবং নানাবিধ প্রতিভার বিকাশের জন্য চলমান সকল কার্য্যক্রমের প্রানভোমরা এই ভলান্টিয়াররাই।
করোনার শুরু থেকেই জুম বাংলাদেশ স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনের জন্য প্রচারনা, কয়েক হাজার মানুষের মধ্যে স্যানিটাইজার, সাবান ও মাস্ক বিতরন এবং প্রায় ১০ হাজার মানুষকে শুকনা খাবার সরবরাহ করেছে। হাতে নিয়েছে রান্না ককরা খাবার সরবরাহের উদ্যোগ। ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে দুই সহস্রাধিক নিরন্ন পথ শিশু, ছিন্নমূল শিশু বা ক্ষুধার্থ মানুষকে রান্না করা খাবার প্রদানের কার্য্যক্রম।
জুম কর্তৃপক্ষ বা শুতানুধ্যায়ীরা হয়তো আর্থিক দায়ীত্বটি নিয়েছেন। কিন্তু করোনা কালের প্রয়োজনে মানবতার ডাকে সাড়া দিয়েছেন ভলান্টিয়াররাই। অনেক পরিকল্পনা ও এদের মাথা থেকেই এসেছে।
ওদের অনেককে কাছ থেকেই দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। এদের অধিকাংশ মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, অনেকেই টিউশনি করে বা পার্টটাইম টুকটাক কাজ করে লোখাপড়ার খরচ নির্বাহ করে। চ্যারিটি করার মত সময় বা সুযোগ এদের হাতে খুব একটা নাই। অনেক সময় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় পরিবার, পকেটের অবস্থা। জুম ওদেরকে কিছুই দিতে পারেনা বলতে গেলে। বরং অনেক সময় কষ্টার্জিত গাটের পয়সা খরচ হয় জুমের কাজ করতে গিয়ে। বিনিময়ে কি পায় ওরা? টাকা পয়সা পায়না, সেই অর্থে কোন স্বীকৃতিও নেই। জুমের মত একটি সংগঠনকে ‘ক’ জনাই বা চিনে। এসব কাজকে ‘ক জনাই বা ওউন করে বা স্বীকৃতি দেয়? খুব একটা নয়।
অথচ আমি কাছ থেকে দেখেছি, কথা বলেছি ওদের সাথে, উৎসাহে ভাটা নেই, ক্লান্তিহীন কাজ করে চলে, মুখে হাসির অন্ত নেই। সামান্য চাল ডালের খিচুড়ি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে মেয়েগুলো পিকনিক মুডে খায়। খরচ বাঁচানোর জন্য নিজেরাই চাল ডালের বস্তা টানে, কাঠের লাকড়িতে রান্না করে, ভ্যান ঠেলে হাতিরঝিল বা সেগুন বাগিচা থেকে কখনো মহানগর নাট্যমঞ্চ, কখনোবা শহীদ মিনার যায় খাবার নিয়ে।
এদের মুখে হাসি গায়ে লাল সবুজ রঙচটা জুম বাংলাদেশের টি-শার্ট। জিজ্ঞেস করে দেখেছি- কেন আসো, কেন এত কষ্ট করো? হাসি মুখে বলে ভাল লাগে, কি ভাল লাগে জিজ্ঞেস করলে এদের চোখ অতলান্ত গভীরতায় হারিয়ে যায়, আস্তে করে বলে অভুক্ত,অবহেলিত বাচ্চাদের হাসিমুখ ভাল লাগে। এরা সবাই এই সব ছোট ছোট দেবশিশুদের আপু বা ভাইয়া।
আমরা কয়েকজন পরিণত বয়সী মানুষও ওদের সাথে থাকি মাঝে মাঝে। এদেরকে দেখলে নিজেদের কেই জিজ্ঞেস করি এদের বয়সে এত কমিটমেন্ট কি আমাদের ছিল? নির্দিধায় বলতে পারি, ছিলনা।
প্রচলিত জীবন যুদ্ধে এদের সাফল্যের তরী তীড়ে ভিড়ে কিনা জানিনা, সমাজও হয়তো এদের কে মেধাবী বা সূর্য সন্তান বলে বরন করবেনা – এসব নিয়েও এদের ভাবনা কম। জিজ্ঞেস করি পড়াশুনার ক্ষতি হয়না তো? হাসি মুখে বলে কিছুটা তো হয়ই, পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করি। বয়সে আমরা তো ওদের অভিভাবকের মতই। ওরা ছাড়া জুম অচল জেনেও বলি পড়ালেখার ক্ষতি যেন না হয়। ওরা কিছু বলেনা, হাসে। নিজের কিছুটা ক্ষতি না করে পরের কাজে লাগার সুযোগ নেই- এই সরল সত্যটি জানি বলেই কিছু বলিনা। ওদের এই পথ চলাতেই আনন্দ।
জুম বাংলাদেশ সহ মানবিক কাজে নিয়োজিত সকল ভলান্টিয়ার্স কে আমার সালাম ও অভিনন্দন। আমরা হয়তো দেখিনা বা আমাদের হয়তো দেখার ক্ষমতাই নেই কিন্তু যিনি সব দেখেন যিনি অন্তর্জামি তিনি নিশ্চয়ই তোমাদের সব কিছু দেখছেন, নিত্য লিপিবদ্ধ হচ্ছে তোমাদের আমলনামা এবং নিশ্চয়ই পরোয়ার দিগার তোমাদেরকে উপযুক্ত সম্মানে সম্মানিত করবেন।
তোমাদের মত না হতে পারি তোমাদের পাশে থাকতে পেরে আমি গর্বিত। রাব্বুল আলামিন সহায় হোন তোমাদের মহৎ কাজের।
লেখক: মো: মনিরুজ্জামান
এডিশনাল ডিআইজি,
এন্টি টেররিজম ইউনিট, ঢাকা
বাংলাদেশ পুলিশ ।