দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে ফ্যাসিবাদবিরোধী সব রাজনৈতিক দলকে ঐক্যবদ্ধ করতে চায় বিএনপি। দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের নিয়ে চলতি মাসের শেষে কিংবা আগামী মাসের শুরুতে ঢাকায় বড় একটি সংবাদ সম্মেলন করার পরিকল্পনা দলটির। আজ প্রথম দিনে ১২ দলীয় জোট ও লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সঙ্গে বৈঠক রয়েছে।
এর মাধ্যমে সরকারকে বার্তা দিতে চায়, বাংলাদেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত এবং তারা আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায়। সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এমন সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে।
বৈঠকে বিএনপি নেতারা অভিমত দেন, এই সরকার গণ-অভ্যুত্থানের ফসল। সুতরাং সরকারের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো কর্মসূচি কিংবা বড় আন্দোলনে যাওয়া যাবে না। সে পরিস্থিতিও এখনো আসেনি। একটি অবাধ-সুষ্ঠু-গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারকে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করছেন তারা। সুতরাং তারা চান না এই সরকার ব্যর্থ হোক। সামগ্রিক বিবেচনায় তাই সরকারের ওপর চাপ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি।
দলটির নেতারা জানান, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গেও বিএনপি বসবে, কৌশলে বোঝাপড়া করবে। দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ও ডিসেম্বরের মধ্যে ভোটের দাবিতে জনমত তৈরি করার জন্য যুগপৎভাবে সভা-সমাবেশ কর্মসূচি পালনের বিষয়ে আলোচনা হবে। এসব কর্মসূচির মধ্য দিয়ে তারা দেশি-বিদেশিদের কাছে এমন বার্তা দিতে চায়-বাংলাদেশের সব গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল দ্রুত নির্বাচন ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ রয়েছে। বিএনপি চায় ফ্যাসিবাদবিরোধী সব রাজনৈতিক দলের পরামর্শ নিয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে। সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখেই নির্বাচনের দাবি আদায় করতে চায়। আর বিএনপির নিজস্ব কিছু কর্মসূচি পালনের বিষয়ে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা হয়। দ্রুত রোডম্যাপ ও ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দাবির সঙ্গে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ নানা ইস্যুও যুক্ত করে বিক্ষোভ ও সমাবেশের কর্মসূচি নেওয়া হতে পারে। ঢাকায় দু-একটি বড় সমাবেশ করারও পরিকল্পনায় রয়েছে। সামনে কোরবানির ঈদ ও বর্ষাকাল, তাই এর আগেই যুগপতের পাশাপাশি নিজস্ব এসব কর্মসূচি পালন করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে ।
এছাড়া নির্বাচন ইস্যুতে সরকার আগামী দু-এক মাসের মধ্যে সুনির্দিষ্ট কী পদক্ষেপ নেয়, সেটা পর্যবেক্ষণ করবে বিএনপি। দলটির শঙ্কা-রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত ও চাওয়া উপেক্ষা করে সরকার নির্বাচনের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে এবং দেশ অস্থিতিশীল হতে পারে। সেক্ষেত্রে সরকারের ওপর চাপ আরও বাড়াতে প্রয়োজনে কঠোর কর্মসূচির দিকেও যেতে পারে বিএনপি।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচনের একটি রোডম্যাপ তো থাকতে হবে। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে রমজান ও মার্চে ঈদুল ফিতর, পরে কোরবানির ঈদ, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা এবং পরে বর্ষকাল আছে। এগুলোর মধ্যে নির্বাচন হবে কিভাবে? সেজন্যই ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন করার উপযুক্ত সময়। নির্বাচন যত দেরি হবে তত পানি ঘোলা হবে। তা হলে যারা পতিত শক্তি আছে তারা নানাভাবে খেলা শুরু করবে। ফ্যাসিবাদের দোসররা অনেকভাবে সুযোগ নিতে পারে। অগণতান্ত্রিক শক্তির উদয় হতে পারে। তাতে করে আমাদের গণ-অভ্যুত্থানের আশা ও আকাঙ্ক্ষা জলাঞ্জলি যাবে। সেটি আমরা হতে দিতে চাই না।
দলটি মনে করে, নির্বাচনমুখী প্রয়োজনীয় সংস্কার কার্যক্রম শেষে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। এর বেশি হলে তা হবে সময়ক্ষেপণ। এছাড়া নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের দুই-একজন উপদেষ্টা এবং দু-একটি দলের একেকরকম বক্তব্যে নির্বাচন প্রলম্বিত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয় বিএনপিতে। দলটি আরও মনে করে, গুম, খুন ও গণহত্যায় জড়িতদের বিচার এবং সংস্কার কার্যক্রমও সেভাবে এগুচ্ছে না। একটি অবাধ-সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য যে ধরনের সংস্কার দরকার, সেগুলো গুছিয়ে আনছে না সরকার।
স্থায়ী কমিটির বৈঠকের মূল এজেন্ডাই ছিল অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে গত বুধবার অনুষ্ঠিত বিএনপির বৈঠক। জানা গেছে, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে কী আলাপ-আলোচনা হয়েছে, শুরুতে বিএনপি মহাসচিব নিজেই তা ব্রিফ করেন। এরপর নির্বাচন ইস্যুতে সরকারের যে মনোভাব-দৃষ্টিভঙ্গি বিএনপির কাছে প্রতীয়মান হয়েছে, তা স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার বৈঠকে তুলে ধরেন।
নেতাদের কাছে মনে হয়েছে, সরকার আগামী ডিসেম্বর থেকে পরবর্তী জুনের কথা বললেও নির্বাচন নিয়ে তারা অনেকটাই উদাসীন। নির্বাচন নিয়ে সরকারের মধ্যে কোনো সিরিয়াসনেস নেই। উপদেষ্টাদের যে বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, তাতে মনে হয়েছে- নির্বাচন জুন পেরিয়ে আগামী বছরের ডিসেম্বরে চলে গেলেও তাদের কোনো সমস্যা নেই; অর্থাৎ নির্বাচন ইস্যুকে সরকার এখনো কার্যত আমলে নিচ্ছে না। এছাড়া সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামী আগামী রোজার আগেই নির্বাচন দাবি করেছে। স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এটা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। জামায়াতের এমন অবস্থানকে ইতিবাচকভাবেই দেখছে বিএনপি।
এমন পরিস্থিতিতে আজ থেকে ফ্যাসিবাদবিরোধী সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক শুরু করবে বিএনপি। এদিন গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে বেলা ৩টায় ১২ দলীয় জোট ও সন্ধ্যা ৭টায় এলডিপির সঙ্গে বৈঠক করবে। একটি সূত্র জানিয়েছে, কারও কোনো বক্তব্যে যেন ভুল বোঝাবুঝি না হয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বক্তব্য কিংবা পোস্ট দেখে বিভ্রান্ত না হওয়া, যেকোনো বিষয়ে গভীর ও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে তারপর মন্তব্য বা বক্তব্য দেওয়া এবং দায়িত্বশীলদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া-দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে এসব বিষয় উঠে আসবে।
জানতে চাইলে এলডিপির মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমদ যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে সরকারে থাকা লোকজন একেক সময় একেক কথা বলছেন। এতে করে জনগণ বিভ্রান্ত হচ্ছে। ডিসেম্বরের মধ্যেই আমরা নির্বাচন চাই। এজন্য দ্রুত একটি সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে। তিনি বলেন, নানা ইস্যুতে বিএনপি সব সময়ই আমাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে। সংস্কার ইস্যুতেও আলোচনা করেছে। এখন সংস্কার ও নির্বাচন সম্পর্কিত বিষয় নিয়েই হয়তো আলাপ-আলোচনা করবে। আমাদের কাছেও মতামত জানতে চাইবে। বিএনপির চিন্তা সম্পর্কেও আমরা জানতে পারব।
১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, আমরা আগে থেকেই ডিসেম্বরের মধ্যে সংসদ নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছি। আমরা মনে করি, নির্বাচনের জন্য একটি টাইম ফ্রেম থাকতে হয়। অন্তর্বর্তী সরকার টাইম ফ্রেম দেবে না, এটা তো হতে পারে না। নির্বাচনের জন্য প্রতিটি দলের প্রস্তুতি নিতে হবে, ভোটসংক্রান্ত অনেক কাজ আছে, সে কাজগুলো করার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট সময় দরকার। আমরা তা চাই। বিএনপির সঙ্গে বৈঠকে হয়তো এসব নিয়ে আলোচনা হবে।