এস আলম
ব্যাংক-শেয়ার বাজার লুটেরা অলিগার্কদের ব্যাংক হিসাবের তথ্য দিতে ব্যাংকগুলো অসহযোগিতা করছে। কখনো ব্যাংক ভুল তথ্য দিচ্ছে, কখনো দেরিতে ব্যাংক হিসাব বিবরণী পাঠাচ্ছে, আবার ক্ষেত্র বিশেষে পরিবারের ব্যাংক হিসাব সম্পর্কে তথ্য দিচ্ছে না। এ কারণে কর ফাঁকি অনুসন্ধানে সময় লাগছে। এস আলমের দুই ছেলের ৫০০ কোটি টাকা বৈধ করতে পে-অর্ডার জালিয়াতি করা হয়। ধরা পড়ায় শেষ পর্যন্ত ব্যাংকের সার্ভারও পর্যন্ত ম্যানুপুলেট করা হয়। এমনকি ব্যাংক হিসাবের তথ্য এনক্রিপ্ট (লুকানো) রাখা হয়।
বুধবার রাজধানীর আগারগাঁও রাজস্ব ভবনে ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মানি লন্ডারিং ও কর ফাঁকি রোধবিষয়ক এক কর্মশালায় এনবিআরের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা এসব তথ্য জানান। ‘মানি লন্ডারিং ও কর ফাঁকি রোধে পারস্পরিক সহযোগিতা’ শীর্ষক কর্মশালার আয়োজন করে আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিট।
এস আলমের ব্যাংক ঋণ জালিয়াতির তথ্য তুলে ধরে সিআইসির মহাপরিচালক আহসান হাবিব বলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে মানবসভ্যতা সৃষ্টির পর সবচেয়ে বড় ব্যাংকিং জালিয়াতি হয়েছে বাংলাদেশে। এই কোম্পানিটির ২ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। ১০টি কম্পিউটারে ৭ জন কর্মকর্তা এক মাস যাবৎ এন্ট্রি দিয়ে শেষ করতে পারেনি। তারা ৬ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা ব্যাংক সুদ আয় হলেও আয়কর রিটার্নে প্রদর্শন করেনি। এ নিয়ে এখনো কাজ চলছে। এতো বড় কাজ কখন শেষ হবে তাও বলতে পারছি না। কেবল ব্যাংক সহযোগিতা করলেই কাজ দ্রুত শেষ করা সম্ভব। আর দেরি করলে রাষ্ট্রের কাজ বিলম্বিত হবে। কাজ বিলম্বিত হয়ে রাজনৈতিক সরকারের ওপর পড়লে এই অলিগার্করা রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাথে আঁতাত করে বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে।
এস আলম বিদেশি নাগরিকত্ব সম্পর্কে তিনি বলেন, বাংলাদেশের জন্মগ্রহণ করেও নাগরিকত্ব বাতিল করে এস আলমের দুই ছেলে এন্টিগুয়া, সাইপ্রাস, সিঙ্গাপুরের নাগরিকত্ব নিয়েছে। সেখানে নাগরিকত্ব নিতে গেলে ২৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ লাগে। তার দুই ছেলে জালিয়াতির করে ৫০০ কোটি টাকা বৈধ করে। তাদের বিষয়ে ৯ আগস্ট ব্যাংক হিসাব তল্লাশি করা হলেও সেই ব্যাংক এখনো বিবরণী জমা দেয়নি। ব্যাংক সহযোগিতা না করায় তদন্ত কাজ অন্তত ৬ মাস পিছিয়ে গেছে।
ব্যাংক ভুল তথ্য দিচ্ছে উল্লেখ করে আহসান হাবিব বলেন, কয়েক দিন আগে এক ব্যক্তির ব্যাংক হিসাবের তথ্য চাওয়া হয়। ব্যাংক থেকে যেই হিসাব বিবরণী পাঠানো হয়েছে তাতে শূন্য লেনদেন দেখানো হয়। কিন্তু আমরা ওই ব্যক্তির ব্যাংক হিসাবে ৩৭৯ কোটি টাকা পেয়েছি। এ বিষয়ে ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের তলব করলে তারা সদুত্তর দিতে পারেনি। ব্যাংকগুলোর এস আলমের মতো নির্দিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবের তথ্য এনক্রিপ্ট (লুকানো) করে রেখেছে। ভুল তথ্য দেয়ায় এখন পর্যন্ত ৭ ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীকে শোকজ করা হয়েছে। আয়কর বিভাগ এখনো এসব বিষয়ে সফটলি ল’ এনফোর্সমেন্ট করছে। যথাযথভাবে প্রয়োগ শুরু করি তাহলে ব্যাংক ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। কখনোই আমরা সেটি করতে চাই না। কারণ আমরা ‘নীল কর’ আদায় করতে চাই না। মোটিভেশনের মাধ্যমে কর আদায় করতে চাই।
তিনি আরও বলেন, ব্যাংকগুলো করদাতাদের সম্পর্কে ভুল তথ্য দেয়, ভুয়া ব্যাংক বিবরণী পাঠায়, বিলম্বিত করে ব্যাংক হিসাব বিবরণী পাঠায়, পরিবারের ব্যাংক হিসাব সম্পর্কে তথ্য দেয় না। শীর্ষ এক ধনীর স্ত্রীর লকার থেকে ১৫ কোটি টাকার ডায়মন্ড পেয়েছি। ১৫ কোটি টাকার এডিআর পেয়েছি। অন্য ২ কোটি টাকা দলিলমূল্যের জমি মর্টগেজ দিয়ে ৪৭ কোটি টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে। এ তথ্যগুলো আমরা ব্যাংক থেকে পাইনি।
ব্যাংক কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে আহসান হাবিব বলেন, অলিগার্করা আর ফিরে আসবে না। এই ভরসায় থাইকেন না। এস আলম তার ড্রাইভারকে চাকরি দিয়েছে, কাজের বুয়াকে ব্যাংকের সিনিয়র এক্সিকিউটিভের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছে। কে কাকে চাকরি দিয়েছে, কে কাকে সুবিধা দিয়েছে, কে কার আত্মীয় আপাতত ভুলে যান। কর বিভাগকে সহযোদ্ধা হিসেবে সহযোগিতা করুন। আর ব্যাংক সহযোগিতা না করলে সেপ্টেম্বরের পর থেকে আইন প্রয়োগ শুরু করবো।
বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (এলটিইউ-আয়কর) কমিশনার খাইরুল ইসলাম বলেন, অনেক কোম্পানির ব্যাংক স্টেটমেন্ট পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, টাকা শুধু উত্তোলনই হচ্ছে। এই টাকা কোথায় যায়, তা খুঁজে পাচ্ছি না। প্রতিদিনই টাকা উত্তোলন হচ্ছে। কোথায় টাকা যাচ্ছে, তা প্রশ্ন করলে ব্যাংক উত্তর দিতে পারছে না।
এনবিআর চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান বলেন, কর বিভাগের চাহিদা অনুসারে তথ্য দেওয়া ব্যাংকের আইনি দায়িত্ব। তথ্য না দিলে আইনে কঠোর হওয়ার কথা বলা আছে। সেটি হলে ব্যাংকগুলো প্রতিষ্ঠান হিসেবে খেলাপি হয়ে যাবে। তখন ওই সব ব্যাংকের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে।