আখতার-উজ-জামান, ইসলাম ও ধর্ম ডেস্ক, আজনিউজ২৪: ইসলাম ও ধর্ম ডেস্ক, আজনিউজ২৪: পবিত্র শবেবরাত আল্লাহর ইবাদতের রাত। মহানবি হযরত মুহাম্মাদ সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বলেছেন— যখন শাবান মাসের চাঁদের ১৫ তারিখের রাত আসবে তখন তোমরা জেগে থেকে আল্লাহর ইবাদত করবে। আর পরদিন রোজা রাখবে। দিন-রাত-মাস-বছর সবই আল্লাহ পাক রাব্বুল আল-আমীনের। তারপরও কিছু কিছু দিন ও রাতের মর্যাদার মধ্যে তারতম্য আছে। সেসব দিন বা রাত অশেষ মহিমান্বিত, সওয়াব ও বরকতের অমিয় ধারায় প্লাবিত। শবেবরাত এমনি এক মহিমান্বিত বরকত ও সওয়াবপূর্ণ পবিত্র রজনি। এ সময় ইবাদত-বন্দেগির সওয়াব অনেক বেশি। শব ফারসি শব্দ। এর অর্থ রজনি বা রাত। আর বরাত শব্দের অর্থ ভাগ্য বা সৌভাগ্য, শব্দটির অন্য অর্থও আছে। শবেবরাতকে আরবিতে বলে লাইলাতুল বারায়াত। লাইলা অর্থ রাত বা রজনি, আর বারায়াত অর্থ মুক্তি, নিষ্কৃতি অর্থ লাইলাতুল বারায়াত মানে মুক্তির রজনি বা নিষ্কৃতির রজনি। কেননা আল্লাহ এ রাতে সূর্যাস্তের পরই সর্বনিম্ন আসমানে নেমে আসেন এবং তাঁর বান্দাদের ডেকে বলেন, ওহে! আছো কোনো ক্ষমা প্রার্থী? আমি তোমাকে ক্ষমা করবো। আছো কোনো রিজিক প্রার্থী? আমি তোমাকে রিজিক দেবো। আছো কোনো বিপদগ্রস্ত? আমি তোমাকে বিপদমুক্ত করবো। আছো কোনো তওবাকারী? আমি তোমার তওবা কবুল করবো। এভাবে সুবহে সাদেক পর্যন্ত আল্লাহ আহ্বান করতে থাকেন (ইবনে মাজাহ)। অন্য এক হাদিসে রাসূল সা. বলেন- শবেবরাতে আল্লাহ স্বীয় রহমতের তিনশ দ্বার খুলে দিয়ে প্রথম আসমানে আসেন এবং সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত তাঁর বান্দােদর এই বলে আহ্বান করতে থাকেন— ‘হে আমার বান্দাহ্গণ আজ তোমরা কে কি চাও? কে রোগ মুক্তি চাও? কে মনোবাসনা পূর্ণ করতে চাও? কে সারা জীবনের গুনাহর ক্ষমা চাও? কে অফুরন্ত সুখের জান্নাত চাও? আজ যে-যা চাও তা পাবে। পবিত্র শবেবরাতের ফজিলত ও মাহাত্ম্য বর্ণনায় আরও অনেক হাদিস আছে যা স্বল্প পরিসরে আলোচনা করা সম্ভব হলো না। শবেবরাতের রাতে আল্লাহর বিশেষ রহমত অনিঃশেষ ধারায় বর্ষিত হতে থাকে তাঁর বান্দােদর ওপর। এ রাতে মানুষের ভালোমন্দ কাজ-কর্ম হিসাব-নিকাশ আল্লাহর কাছে পেশ করা হয়।
নফল নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত, দরূদপাঠ, দান-খয়রাত, দু’আ-মুনাজাতের মধ্য দিয়ে আজ রাত পালিত হচ্ছে লাইতুল বরাত। পরম করুণাময়ের দরবারে নিজের সারা জীবনের দোষ-ত্রুটি, পাপকাজ ও অন্যায়ের জন্য ক্ষমা প্রার্থনার রাত। এ রাতে সর্বশক্তিমান আল্লাহ পরবর্তী বছরের জন্য বান্দার রিজিক নির্ধারণ করে সবার ভাগ্যলিপি লেখেন এবং বান্দার সব গুনাহ মাফ করে দেন। মুসলমানদের কাছে শাবান মাসের ১৪ তারিখের দিবাগত রজনি অত্যন্ত বরকতময় ও মহিমান্বিত বলে বিবেচিত। আল্লাহ পাক মানবজাতির জন্য তাঁর অসীম রহমতের দরজা এ রাতে খুলে দেন। অন্তরকে কলুষমুক্ত করে ভক্তি ও আশা-ইয়াকিন সহকারে নফল নামাজ, তিলাওয়াত-ই-কুরআন, দরূদপাঠ, দান-খয়রাত, দু’আ-মুনাজাত প্রভৃতি ইবাদতে নিজেকে মশগুল রাখতে হবে।
শবেবরাতের নামাজের নির্ধারিত কোনো নিয়ম নেই। দুইরাকাত থেকে ২০ রাকাত পর্যন্ত নফল নিয়তে নামাজ পড়তে হয়। এ পবিত্র রাতের ইবাদত-বন্দেগীর মর্যাদা সম্পর্কে পরিবারের সদস্যদেরও উৎসাহ ও গুরুত্ব অনুধাবন করাতে হবে। শেষ রাতের দিকে পরিবারের সবাইকে আল্লাহর রহমত ও বরকতের অংশীদার হওয়ার জন্য ইবাদত ও দু’আ-মুনাজাতে মশগুল করাতে হবে যেন ছোট-বড় সকলেই রহমতের অংশ নিয়ে সৌভাগ্যবান হতে পারে। করণীয় আমলের সাথে কতগুলো বর্জনীয় বিষয়ও জড়িত থাকে। সে বিষয় বর্জন না করলে শবেবরাতের বরকত থেকে মাহরুম হতে হয়। সফলতার পরিবর্তে ব্যর্থতা, রহমতের পরিবর্তে গযব, সওয়াবের পরিবর্তে আযাবই নসিব হয়। তাই এ রাতে অপব্যয় ও অপচয় না করে অযথা আতশবাজিতে অনর্থক অর্থ অপচয় না করে সে অর্থ কল্যাণকর কাজে বা ফকির-মিসকিনের মাঝে দান করে দেয়া অনেক সওয়াব ও বরকতের কাজ। প্রকৃৃতপক্ষে শবেবরাতের বৈশিষ্ট্য অনুষ্ঠানের আড়ম্বরতার মধ্যে নয়, বরং চরিত্রবলের সাধনার মাধ্যমে করুণাময়ের করুণা লাভের প্রয়াসই এর তাৎপর্য। সর্বস্ব সম্পূর্ণ করে নিঃশেষে আত্মনিবেদনের মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে ডাকাই এ পবিত্র রাতের প্রধান কাজ। এ রাতের গুরুত্ব সম্পর্কে হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, পরবর্তী বছরের যাবতীয় ফয়সালা— হায়াত, মউত, রিজিক, দৌলত, আমল ইত্যাদির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত আদেশ-নিষেধসমূহ ওই রাতে লওহে মাহফুজ থেকে উদ্ধৃত করে কার্যনির্বাহক ফেরেশতাদের কাছে সোপর্দ করা হয়।
কবি গোলাম মোস্তফা কবিতায় মহিমান্বিত এই রাতকে নিয়ে তার সুন্দর উপস্থাপন— সারা মুসলিম দুনিয়ায় আজি এসেছে নামিয়া ‘শবেবরাত’/ রুটি রোজগার-জান-সালাম বণ্টন-করা পুণ্য রাত।
মসজিদে তো দৈনিক পাঁচবার নামাজের ইবাদত হচ্ছেই। নিজেদের বাসা-বাড়িকেও ইবাদতের গৃহ হিসেবে গড়ে তোলা উচিত। তাছাড়াও সকল নফল ইবাদত মসজিদের চেয়ে বাড়িতে পালন করাই উত্তম। সাহাবি-তাবেয়ির যুগেও এ পরিভাষাটির ব্যবহার পাওয়া যায় না। এ রাতটিকে হাদিস শরিফে ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ বা ‘মধ্য শাবানের রজনি’ বলা হয়েছে। শবেবরাত মূলত আল্লাহর ইবাদতের রাত, তাঁর রহমত ও পরম সৌভাগ্য তাঁর নিকট থেকে চেয়ে নেয়ার রাত। তাই এ রাতে এক মনে আল্লাহর ইবাদত করাই আমাদের একমাত্র কর্তব্য। কেননা, এ রাতে নিজের গোনাহ বা পাপের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া হলে তিনি তা কবুল করেন। এ পবিত্র রাতে তাঁর রহমত অজস্রধারায় তাঁর বান্দােদর ওপর বর্ষিত হতে থাকে।
আসুন এ রাতে আমরা মুনাজাত করি— হে আল্লাহ আমাদের বরাত খুলে দাও এ পবিত্র রাতে, আমরা তোমার সাহায্য প্রার্থনা করছি, তুমি আমাদের সকল গুনাহ মাফ করে দাও।
প্রকৃতপক্ষে শবেবরাতের বৈশিষ্ট্য অনুষ্ঠানের আড়ম্বরতার মধ্যে নয়, বরং চরিত্রবলের সাধনার মাধ্যমে দয়াময়ের করুণা লাভের আন্তরিক প্রয়াসই এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য। এ রাতে অহেতুক আলোকসজ্জা করা, তারাবাতি জ্বালানো, আতশবাজি পোড়ানো, পটকা ফোটানো প্রভৃতি শরিয়ত গর্হিত কাজ। এতে অপসংস্কৃতির সঙ্গে যেমন সাদৃশ্য তৈরি হয়, তেমনি ইবাদতেও যথেষ্ট বিঘ্ন ঘটে। শিশু-কিশোর ও তরুণ-তরুণীদের এ বিষয়ে সতর্ক করা অবশ্যকর্তব্য। প্রকৃতপক্ষে শবেবরাত উপলক্ষে এ দেশে ধর্মপ্রাণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এক অভূতপূর্ব জাগরণ সৃষ্টি হয়। ইমানদার মানুষের মধ্যে অতুলনীয় এক ধর্মীয় অনুভূতি ও চেতনা পরিলক্ষিত হয়। এ রাতে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করাই বান্দার একমাত্র কর্তব্য। তাই সৌভাগ্য আর রিজিক বরাদ্দের, জীবন-মৃত্যুর দিনক্ষণ নির্ধারণের রজনিতে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর কাছে সর্বপ্রকার গোঁড়ামি ও শিরক থেকে পরিত্রাণ লাভের প্রার্থনা করা উচিত। আল্লাহ পাক যেন মুসলিম জাহানের সুখ-শান্তি ও কল্যাণের জন্য তাঁর রহমতের দরজা সারা বছরই খুলে রাখেন এটাই কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা।
বিশ্বের সকল মুসলিম বিশেষ করে বাংলাদেশের মুসলমানদের এই রাতের উছিলায় সকল নিয়ামত অর্জিত হোক— এটাই আল্লাহ পাক রাব্বুল আল-আমীনের কাছে আমাদের বিশেষ প্রার্থনা। এই বরকতময় রজনিতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে আমরা আমাদের গোনাহ মাফের সর্বোচ্চ সুযোগটিকে গুরুত্ব দেই। মহান আল্লাহ রাব্বুল আল-আমীনের কাছে সব মানুষের কল্যাণের জন্য প্রার্থনা করছি। সেই সাথে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমার/আপনাদের শত্রুদের ক্ষমা করে দিয়ে তাদের সুপথে চালিত করুন। মহান আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে পবিত্র লাইলাতুল বরাত যথাযথ আদায় করার তাওফিক দান করুন। সারা রাত জাগরণ করে ইবাদত-বন্দেগির চেয়ে শুধু মসজিদে-মসজিদে ঘোরাঘুরি করা আর রাস্তায়- গল্প-গুজবে মশগুল থাকা এই রাতের মর্যাদাপরিপন্থি কাজ। বরং, এ রাতে মসজিদে সমবেত না হয়ে বাড়িতে একাকী ইবাদত করাই উত্তম। ইবাদত-বন্দেগির পাশাপাশি সন্ধ্যার পর অনেক মুসল্লি যাবেন কবরস্থানে। চিরনিদ্রায় শায়িত আপনজনদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে এদিন রাতে বিশেষ দোয়া করবেন সবাই। তবে বিশ্বের সাথে সাথে কোভিড-১৯ করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ চলছে এ বছরও। সারা দেশে সৃষ্ট করোনা ভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির জন্য জনসমাগম এড়াতে দেশবাসীকে সন্ধ্যার পর কবরস্থানে যাওয়া কিংবা সম্মিলিতভাবে জড়ো না হওয়াই ভালো। একই সাথে বিভিন্ন মসজিদে গেলেও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ইবাদত করাটাই শ্রেয়। শবেবরাত মুসলিমদের কাছে রমজানের আগমনী বার্তা বয়ে আনে। তাই শবেবরাতের রাত থেকে আসন্ন রমজানের প্রস্তুতিও শুরু হয়ে যায়।
লেখক : গবেষক, সাংবাদিক