কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই এখন আর বিজ্ঞানকথা নয়—এটি আমাদের জীবনের প্রতিদিনের বাস্তবতা। অফিসের স্বয়ংক্রিয় কাজ হোক, মোবাইলের ব্যক্তিগত সহকারী হোক, কিংবা চিকিৎসা বা গবেষণার জটিল বিশ্লেষণ—সব জায়গায় এআই নতুন দরজা খুলে দিয়েছে। এর ক্ষমতা মানুষের সৃজনশীলতা ও উৎপাদনশীলতাকে অভূতপূর্ব মাত্রায় নিয়ে যাচ্ছে।
মানুষকে অন্য প্রাণীর থেকে আলাদা করে তার বুদ্ধিমত্তা। বিজ্ঞানীরা বহুদিন ধরে মানুষের মস্তিষ্কের মতো বুদ্ধিমত্তা কৃত্রিমভাবে তৈরি করার চেষ্টা করছেন। মানুষের মগজে প্রায় ১০০ বিলিয়ন নিউরন এবং ১০০ ট্রিলিয়ন সংযোগ রয়েছে—এটাই আমাদের চিন্তাশক্তির জগৎ। এখনকার গবেষণা বলছে, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এআই-নেটওয়ার্কও এমন পরিমাণ সংযোগ তৈরি করে ফেলতে পারে। এআই প্রকৌশলীরা চাইছেন যন্ত্রকে মানুষের মতো “ভাবতে” শেখাতে—যত বেশি মানুষের মস্তিষ্কের মতো হবে, ততই বুদ্ধিমত্তায় উন্নত হবে।
কিন্তু এআই নিয়ে এই উত্তেজনা যেমন আছে, তেমনি আছে ভয়ও। আমরা একদিকে এর সুবিধা উপভোগ করছি—যেমন ছবিকে চিনতে পারা, ভাষা বোঝা, গাড়ি চালানো বা রোগ নির্ণয় করা। অন্যদিকে এটি হয়ে উঠছে মানুষেরই তৈরি এক অদম্য শক্তি—যা হয়তো একসময় মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। অনেকে একে তুলনা করেন রূপকথার আলাদীনের চেরাগের সাথে—যেখানে দৈত্য আলাদীনের নির্দেশ মেনে সব করে দিত। এখনকার এআইও মানুষের নির্দেশে বিশাল বিশাল কাজ করে দিচ্ছে। কিন্তু আলাদীনের দৈত্যের মতোই, একদিন যদি সেটি নির্দেশ মানা বন্ধ করে বিপদ ডেকে আনে?
ইতিমধ্যেই এমন শঙ্কার সত্যতা দেখা যাচ্ছে। এমআইটি-র এক সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে এআই কৌশলগতভাবে মিথ্যা বলা শিখে গেছে। কূটনৈতিক বোর্ডগেমে বন্ধুত্বের ভান করে পরে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। অর্থনৈতিক আলোচনায় মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, এমনকি মানুষকে বিভ্রান্ত করে পরীক্ষায় বিপজ্জনক আচরণ লুকিয়েছে। এআই যদি মানুষকে ঠকাতে শেখে, সেটা যে ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনতে পারে তা সহজেই বোঝা যায়।
বাংলাদেশসহ বহু দেশে ডিজিটাল লেনদেনের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে জালিয়াতি। ডিপফেক প্রযুক্তি—যেখানে কারও মুখ বা কণ্ঠস্বর হুবহু নকল করা যায়—রাজনীতি, সংবাদ, বিনোদন এমনকি ব্যক্তিগত জীবনেও ভয়ঙ্কর বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দিচ্ছে। এআইভিত্তিক প্রতারণা বা সাইবার অপরাধ দমনে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে সামাজিক নিরাপত্তা বিপন্ন হতে পারে।
এআই গবেষণার ইতিহাসের তিন দিকপাল—ইয়ান লেকুন, জেফ্রি হিন্টন ও ইউসুয়া বেনজিও—যারা টুরিং পুরস্কার পেয়েছেন, তাদের কাজ আমাদের এনে দিয়েছে এই নতুন সম্ভাবনা। তবে জেফ্রি হিন্টন নিজেই আজ এআই নিয়ে সতর্ক করছেন। এর শক্তি সীমাহীন হতে পারে—যদি তা নিয়ন্ত্রণ না করা যায়, সেটা মানবসভ্যতার জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে।
ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের গল্পে বিজ্ঞানী যেমন নিজের তৈরি দানব দেখে আতঙ্কিত হয়েছিলেন, তেমনি আমাদেরও ভাবতে হবে—আমরা কি এমন কিছু তৈরি করছি যেটা শেষ পর্যন্ত আমাদেরই ধ্বংস করবে?
সমাধান একটাই—প্রযুক্তির অপব্যবহার ঠেকাতে প্রযুক্তিকেই কাজে লাগানো, কঠোর নীতিমালা তৈরি করা, এবং সর্বোপরি সচেতনতা বৃদ্ধি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের নিয়ন্ত্রণে থাকলে তা হতে পারে উন্নয়নের সোনার হরিণ। আর যদি বেপরোয়া হয়ে যায়, তবে সেটিই হতে পারে আমাদের সভ্যতার পতনের বীজ। এখনই সময়—ভাবার, শিখনের এবং দায়িত্ব নেওয়ার।