বাংলাদেশের কর্মজীবী তরুণসমাজ আজ এক কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি— ‘চাকরি করব, নাকি নিজেই কিছু করব?’ এই প্রশ্নে যেমন লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতের নিরাপত্তার চিন্তা, তেমনি রয়েছে আত্মপরিচয় গড়ার স্বপ্ন, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার দ্বন্দ্ব।
বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ২০ লাখেরও বেশি তরুণ শ্রমবাজারে প্রবেশ করেন কিন্তু সরকার ও বেসরকারি খাতে চাকরির সুযোগ তৈরি হয় মাত্র কয়েক লাখের জন্য। এই পরিস্থিতিতে তরুণদের একটি বড় অংশ বাধ্য হচ্ছেন বিকল্প চিন্তা করতে। অনেকে ভাবছেন উদ্যোক্তা হবেন কিন্তু সমাজব্যবস্থা ও বাস্তবতা যেন বারবার প্রশ্ন করে— ‘তুমি কে? তুমি কি পারবে?’
চাকরির পথ: নিরাপত্তার আশ্বাস, সীমাবদ্ধতার ফাঁদ
চাকরি আজও বাংলাদেশের তরুণদের কাছে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত ও নিরাপদ পেশা। বিশেষ করে সরকারি চাকরির প্রতি রয়েছে ব্যাপক আকর্ষণ, যেখানে মাস শেষে নিশ্চিত বেতন, পেনশন ও অন্যান্য সুবিধা, পরিবার ও সমাজের শ্রদ্ধা ও আস্থা। তবে এর পাশাপাশি রয়েছে কিছু বাস্তব সীমাবদ্ধতা। যেমন:
সৃষ্টিশীলতার অভাব: স্থায়ী কাঠামোর মাঝে নতুন কিছু উদ্ভাবনের সুযোগ খুবই কম।
পদোন্নতিতে ধীরগতি ও রাজনীতিকরণ: যোগ্যতার চেয়ে সিনিয়রিটির ভিত্তিতে মূল্যায়ন।
স্বাধীনতার অভাব: নিজের সিদ্ধান্ত, সময় ও পথচলার স্বাধীনতা অনেকাংশেই সীমিত।
উদ্যোক্তার পথ: অনিশ্চয়তা, স্বাধীনতা ও সৃষ্টির সম্ভাবনা
উদ্যোক্তা হওয়ার মানে হচ্ছে নিজেই নিজের রাস্তা তৈরি করা। এটি একদিকে যেমন ঝুঁকিপূর্ণ, অন্যদিকে তেমনি উত্তেজনাময় ও স্বাধীন।
উদ্যোক্তার পথে আকর্ষণীয় কিছু দিক:
১. স্বাধীনতা: নিজের সময়, সিদ্ধান্ত ও স্বপ্ন নিয়ে এগোনো যায়।
২. সৃষ্টিশীলতা: সমস্যা চিহ্নিত করে তার সমাধান বের করার স্বাধীনতা।
৩. সম্ভাবনা: সফল হলে চাকরির চেয়ে বহুগুণ বেশি আয় ও প্রভাব তৈরির সুযোগ।
৪. কর্মসংস্থান সৃষ্টি: নিজে শুধু আয় করেন না, অন্যকেও কাজের সুযোগ দেন।
বাংলাদেশে বিকাশ, পাঠাও, টেন মিনিট স্কুল, শপআপ ও চালডাল ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান প্রমাণ করেছে যে স্থানীয় উদ্যোগ বৈশ্বিক মানে পৌঁছাতে পারে।
তাহলে তরুণরা দ্বিধায় কেন?
বহু তরুণ নিজে কিছু করতে চাইলেও এক ধরনের দোটানায় থাকেন— ‘আমি কি পারব?’, ‘পরিবার মানবে তো?’, ‘পুঁজি পাব কোথায়?’ ইত্যাদি।
এই দ্বিধার পেছনে রয়েছে:
১. সামাজিক চাপ: ‘লো চাকরি করছো না কেন?’- পরিবার ও সমাজের চাপ একটা বিশাল বাধা।
২. আর্থিক সীমাবদ্ধতা: উদ্যোক্তা হতে পুঁজি লাগে, যা সবার হাতে থাকে না।
৩. ব্যর্থতার ভয়: ব্যর্থতা বাংলাদেশে এখনও লজ্জার বিষয়, শেখার নয়।
৪. নির্ভরযোগ্য পরামর্শদাতা বা মেন্টরের অভাব: তরুণদের হাতে আছে আইডিয়া, কিন্তু দিকনির্দেশনা নেই।
উদ্যোক্তা বনাম চাকরি: আসলে কি কোনো প্রতিযোগিতা?
এই দুটি পথকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করা ভুল বরং এটা বলা যায়- চাকরি থেকে শিখে পরে উদ্যোক্তা হওয়া যায়, উদ্যোক্তা ব্যর্থ হলে চাকরি বেছে নেওয়া যায়। অনেক সফল উদ্যোক্তা নিজে চাকরি করেই অভিজ্ঞতা ও মূলধন তৈরি করেছেন।
আসলে প্রশ্নটা চাকরি নাকি উদ্যোক্তা— সেটা নয়। প্রশ্নটা হলো- আমি কী হতে চাই, কোন পথে আমার দক্ষতা, কিভাবে আমার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে।
উদ্যোক্তা ইকোসিস্টেম তৈরিতে রাষ্ট্র ও শিক্ষাব্যবস্থার করণীয়:
যেখানে তরুণদের দ্বিধা, সেখানেই রাষ্ট্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রের উচিত-
১. উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে ক্ষুদ্রঋণ ও কর সুবিধা দেওয়া।
২. উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ ও মেন্টরিং প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা।
৩. ব্যর্থতাকে শিক্ষার অংশ হিসেবে তুলে ধরা।
৪. বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে উদ্যোক্তাবিষয়ক কোর্স অন্তর্ভুক্ত করা।
৫. ইনোভেশন ল্যাব ও বিজনেস ইনকিউবেটর তৈরি করা।
৬. ছাত্রদের স্টার্টআপ ক্লাব, হ্যাকাথন ও পিচ প্রতিযোগিতায় উৎসাহ দেওয়া।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তরুণদের ওপর। তাদের মধ্যে যারা উদ্যোক্তা হতে চায়, তাদেরকে ঠেকানোর নয় বরং তাদেরকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা দেওয়ার সময় এসেছে। আবার যারা চাকরি করতে চায়, তাদেরও যেন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা থাকে- সম্মানের, ন্যায্যতার ও দক্ষতা অনুযায়ী।
অর্থনীতির ভবিষ্যৎ গড়বে সেই সমাজ, যারা তরুণদের স্বপ্নকে ভয় নয়, সাহস দেখার চোখে দেখে। তাদের পথ বেছে নিতে দিই, কিন্তু সেই পথে যেন আলোর অভাব না থাকে।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিজিডি) ও পিএইচডি গবেষক