বর্তমান বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হলো পরিবেশ সংকট। পরিবেশ দূষণ, প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয়, এবং জলবায়ু পরিবর্তন এই সংকটের মূল উপাদান। পরিবেশের এই অবনতি আমাদের টেকসই উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করছে। টেকসই উন্নয়ন বলতে বোঝায় এমন একটি উন্নয়ন যা বর্তমান প্রজন্মের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম হয়। ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে পরিবেশের গুরুত্ব অপরিসীম, এবং কোরআনের শিক্ষা পরিবেশ সংরক্ষণ ও টেকসই উন্নয়নের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
ইসলামের মূল ভিত্তি হলো মানবিকতা ও ন্যায়বিচার। এই নীতি শুধু মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতিও তা প্রযোজ্য। মহান আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে পৃথিবীর খিলাফত বা অভিভাবকত্ব দানের মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করার দায়িত্ব দিয়েছেন। কোরআনের সূরা আনআমে আল্লাহ বলেন, “তিনিই হচ্ছেন সেই সত্তা যিনি পৃথিবীতে তোমাদের উত্তরাধিকারী করেছেন।” (সূরা আনআম, ৬:১৬৫)। এই আয়াতে মানবজাতিকে পরিবেশের রক্ষক ও অভিভাবক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যা থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে প্রকৃতির সংরক্ষণে আমাদের দায়িত্ব অপরিসীম।
পরিবেশের সংরক্ষণে ইসলামের মূল শিক্ষা হলো ভারসাম্য বজায় রাখা। কোরআনে বলা হয়েছে, “আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং এর মধ্যকার সমস্ত কিছুর মধ্যে আল্লাহ সুষম ভারসাম্য স্থাপন করেছেন।” (সূরা আর-রহমান, ৫৫:৭-৯)। এই আয়াতের মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে যে সৃষ্টিজগতে সবকিছুই সঠিকভাবে পরিমাপ করা হয়েছে এবং এই ভারসাম্য বিঘ্নিত হলে পৃথিবীর প্রকৃতি বিনষ্ট হয়ে যাবে। অতএব, ইসলামের নির্দেশনা অনুযায়ী পরিবেশের প্রতি আমাদের আচরণও হওয়া উচিত পরিমিতি বোধসম্পন্ন ও দায়িত্বশীল।
পরিবেশ সংরক্ষণে ইসলামী নীতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সম্পদের অপচয় রোধ। কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তোমরা অপচয় করো না; নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না।” (সূরা আল-আ’রাফ, ৭:৩১)। পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ হলো প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহার। অতিরিক্ত সম্পদ আহরণ ও তা বিনষ্ট করার প্রবণতা পরিবেশের ক্ষতি সাধন করছে। ইসলামের এই শিক্ষা মানবজাতিকে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারে সংযমী হতে উদ্বুদ্ধ করে, যা টেকসই উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।
ইসলামের দৃষ্টিতে পানির গুরুত্বও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) পানির সঠিক ব্যবহার এবং সংরক্ষণে জোর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “যখন তুমি নদীর তীরে ওজু করো, তখনো পানি অপচয় করো না।” (মুসলিম শরীফ)। এই শিক্ষাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ বর্তমানে পানির অপ্রতুলতা ও দূষণ একটি বৈশ্বিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইসলামের এই নির্দেশনা পরিবেশবান্ধব আচরণেরই প্রতিফলন, যা টেকসই উন্নয়নের এক অপরিহার্য উপাদান।
কোরআনের পাশাপাশি হাদিসেও পরিবেশ সংরক্ষণের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে। হযরত মুহাম্মদ (স.) বৃক্ষরোপণের ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “যদি কোনো ব্যক্তি একটি বৃক্ষ রোপণ করে এবং তা থেকে মানুষ, প্রাণী বা পাখি উপকৃত হয়, তবে তা সেই ব্যক্তির জন্য সদকা হিসেবে গণ্য হবে।” (সহীহ বোখারী)। বৃক্ষরোপণ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং এটি টেকসই উন্নয়নের জন্য অত্যাবশ্যক। তাই, ইসলামের এই শিক্ষা বৃক্ষরোপণ ও পরিবেশ সংরক্ষণে আমাদের উদ্বুদ্ধ করে।
ইসলামের আরেকটি মূলনীতি হলো জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ। কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, “পৃথিবীতে চলমান প্রতিটি প্রাণীকেই আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করেছেন।” (সূরা আল-ইনফিতার, ৮২:৬)। এই আয়াতের মাধ্যমে বোঝা যায় যে প্রতিটি জীবের একটি নির্দিষ্ট ভূমিকা আছে এবং এই জীববৈচিত্র্য আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ। অতএব, ইসলাম জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণে উৎসাহ দেয়, যা পরিবেশের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে সহায়ক।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে ইসলামী শিক্ষার আরেকটি প্রাসঙ্গিকতা হলো অতি ভোগবাদ থেকে বিরত থাকা। বর্তমান বিশ্বে ভোগবাদিতার প্রবণতা পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এই প্রেক্ষাপটে ইসলামের নির্দেশনা হলো সংযম ও মিতব্যয়িতা। মহানবী (স.) বলেছেন, “সংযম হলো প্রতিটি কাজের মধ্যে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা।” (তিরমিজি)। ভোগবাদের বিপরীতে ইসলামের এই শিক্ষা মানবজাতিকে প্রকৃতি ও পরিবেশের সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সহায়ক।
ইসলামের পরিবেশ সংরক্ষণের নীতিগুলো শুধু ধর্মীয় আঙ্গিকেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এগুলো আধুনিক বৈজ্ঞানিক ও পরিবেশবাদী নীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। বর্তমান টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যগুলো যেমন: জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, সম্পদের অপচয় রোধ, এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা—এসব বিষয়ে ইসলামের শিক্ষা অত্যন্ত সুস্পষ্ট। তাই, কোরআনের আলোকে পরিবেশ সংরক্ষণ আমাদের দায়িত্ব এবং এই শিক্ষাকে প্রাত্যহিক জীবনে প্রয়োগ করা আমাদের নৈতিক কর্তব্য।
পরিবেশের প্রতি আমাদের দায়িত্ব সম্পর্কে কোরআনের নির্দেশনা আমাদেরকে একটি সুস্থ, স্থিতিশীল ও টেকসই পৃথিবী গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। ইসলামের এই শিক্ষা অনুসরণ করে আমরা শুধুমাত্র পরিবেশ রক্ষায় অবদান রাখতে পারব না, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর ও বাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যেতে সক্ষম হব। অতএব, কোরআনের আলোকে পরিবেশ সংরক্ষণ ও টেকসই উন্নয়ন একে অপরের পরিপূরক এবং এই শিক্ষাকে বাস্তবায়ন করা বর্তমান সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ।
সহযোগী অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ
হাবীবুল্লাহ্ বাহার কলেজ, ঢাকা।