ইসলাম একটি শান্তি ও সমতার ধর্ম। এর মূল বার্তা মানবতার কল্যাণ, শান্তি, এবং সহমর্মিতা প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানায়। যখন আমরা ইসলামের মূলনীতিগুলোর দিকে তাকাই, তখন দেখতে পাই যে এটি সকল ধর্ম ও বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের নির্দেশ দেয়। মানবিক সম্প্রীতি ও সহনশীলতা ইসলামের মৌলিক শিক্ষা। বর্তমান বিশ্বে চলমান বৈশ্বিক সংঘাত এবং ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার প্রেক্ষাপটে এই শিক্ষা আরো প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। ইসলামে আন্তঃধর্মীয় সহনশীলতার গুরুত্ব এবং এটি কিভাবে বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে, তা নিয়ে গভীরভাবে আলোচনা প্রয়োজন।
প্রথমেই, ইসলামের ভিত্তি হিসেবে কুরআন এবং হাদিসের দিকে নজর দিলে স্পষ্ট হয় যে ইসলাম সবসময় ধর্মীয় সহনশীলতা এবং শান্তির আহ্বান জানায়। কুরআনে বলা হয়েছে, “তোমাদের ধর্ম তোমাদের জন্য, আমার ধর্ম আমার জন্য” (সূরা কাফিরুন, ১০৯:৬)। এই আয়াতটি ইসলামের মধ্যে ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সহনশীলতার একটি প্রমাণ। এখানে ইসলাম কোনো ধর্মীয় অত্যাচার বা জোরজবরদস্তির পক্ষে নয় বরং প্রতিটি মানুষকে তাদের নিজস্ব ধর্ম পালনের অধিকার দিয়েছে। এই ধরনের শিক্ষা থেকে প্রমাণিত হয় যে ইসলাম মানবিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সহনশীলতা ও সম্মানের শিক্ষা দেয়।
অন্যদিকে, হাদিসেও বহুবার ধর্মীয় সহনশীলতা ও সম্প্রীতির উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সেই ব্যক্তি, যার কাছ থেকে অন্যরা নিরাপত্তা পায়।” (সহীহ বুখারী)। এই বক্তব্যের মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে, শুধুমাত্র মুসলমানদের সঙ্গেই নয়, বরং অন্য ধর্মের মানুষদের সাথেও সমানভাবে সহানুভূতিশীল এবং শান্তিপূর্ণ আচরণ করা উচিত। ইসলামের শুরু থেকে মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনে বহুবার এই সহনশীলতার উদাহরণ পাওয়া যায়। মদিনায় মহানবী (সা.) যখন মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপন করেছিলেন, তখন সেটি মানব ইতিহাসে আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির একটি অন্যতম দৃষ্টান্ত।
বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও সম্প্রীতির প্রয়োজনীয়তা আরো স্পষ্টভাবে অনুভূত হচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে ধর্মীয় দ্বন্দ্ব ও সংঘাত তৈরি হয়েছে, যা মানবিক সহাবস্থানের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সন্ত্রাস, ঘৃণা এবং ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা বিশ্বজুড়ে শান্তির পথে বড় বাধা সৃষ্টি করছে। এই সংকটের সমাধানে ইসলামের সম্প্রীতির শিক্ষা অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে।
সমসাময়িক বিশ্বে মুসলমানদের বড় একটি দায়িত্ব হলো, ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা অনুসারে অন্য ধর্মের মানুষের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করা। ইসলামের ঐতিহ্যগত মূল্যবোধগুলি পুনরায় জাগ্রত করা এবং সমাজে তা প্রতিষ্ঠিত করা এখন সময়ের দাবি। ইসলামে “উম্মাহ” ধারণা একটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যেখানে সমগ্র মানবজাতিকে একটি বৃহত্তর সমাজ বা গোষ্ঠী হিসেবে দেখা হয়। এই নীতি অনুসারে মুসলমানরা তাদের চারপাশের সকল মানুষের জন্য দায়িত্বশীল। এটি শুধু মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্যই নয়, বরং সকল ধর্ম, জাতি এবং সম্প্রদায়ের প্রতি একই সম্মান ও সম্প্রীতির বার্তা বহন করে।
ইসলামের শিক্ষার মাধ্যমে ধর্মীয় সহনশীলতার বাস্তবায়ন আমাদের বিশ্বকে একটি শান্তিপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে যেতে পারে। বর্তমান সময়ে বিশেষত মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, এবং এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ধর্মীয় সহিংসতা ও সংঘাত চলছে। এগুলো সমাধানে ইসলামের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের শিক্ষা একটি কার্যকর পন্থা হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ইসলাম ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের রক্ষার জন্য সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছে। হযরত ওমর (রা.) এর খিলাফতের সময় এই ধরনের উদাহরণ অনেক দেখা গেছে, যেখানে তিনি অমুসলিমদের রক্ষা করার জন্য ইসলামের নির্দেশ মেনে চলেছেন। এই ধরনের উদাহরণ বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তাছাড়া, আন্তঃধর্মীয় সংলাপও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ইসলামিক শিক্ষায় বলা হয়েছে যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে যেকোনো সমস্যা সমাধান করা যেতে পারে। সমসাময়িক সমাজে এই ধরনের সংলাপের প্রয়োজন আরও বেড়েছে। ধর্মীয় নেতারা একে অপরের সাথে আলোচনা এবং বোঝাপড়ার মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে পারেন। আল কুরআনের ২:২৫৬ নম্বর আয়াতেও বলা হয়েছে, “ধর্মের ব্যাপারে কোনো জোর জবরদস্তি নেই”। এই শিক্ষা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে ইসলামে ধর্মীয় স্বাধীনতার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এবং সকলকে নিজস্ব বিশ্বাস পালনের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া, বর্তমান বৈশ্বিক সংঘাত এবং ইসলামের ভুল ব্যাখ্যার প্রেক্ষাপটে মুসলিম নেতাদের উচিত শান্তিপূর্ণ সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া। কিছু বিভ্রান্ত গোষ্ঠী ইসলামের নামে সহিংসতার আশ্রয় নিচ্ছে, যা ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা নয়। মূলত, ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা এবং এর ইতিহাসই বলে দেয় যে ইসলাম কখনো সহিংসতার সমর্থক নয় বরং শান্তির বার্তা প্রদানকারী ধর্ম।
ধর্মীয় সহনশীলতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বর্তমান বৈশ্বিক সংঘাতের সমাধান করা সম্ভব। আমাদের বিশ্ব এখন এমন একটি যুগে প্রবেশ করেছে, যেখানে তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে যোগাযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে, তবে সেই সাথে ভুল বোঝাবুঝিও বেড়ে চলেছে। এই প্রেক্ষাপটে, ইসলামের শান্তির বার্তা এবং আন্তঃধর্মীয় সহিষ্ণুতার শিক্ষা পুনরায় উপলব্ধি করা অপরিহার্য। সমাজে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ একত্রে বসবাস করছে, এবং এই বৈচিত্র্যের মধ্যেই শান্তি ও সমৃদ্ধির মূলমন্ত্র লুকিয়ে আছে।
ইসলামের মূল শিক্ষা অনুযায়ী, আল্লাহর সৃষ্টি হিসেবে প্রতিটি মানুষই মূল্যবান, এবং তাদের সাথে সহানুভূতি ও শ্রদ্ধা সহকারে আচরণ করা উচিত। এ ধরনের শিক্ষা বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত কার্যকরী হতে পারে। একে অপরকে বুঝতে চেষ্টা করা, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা বজায় রাখা, এবং মানবতার প্রতি সমান দায়িত্ব পালন করা এখন সময়ের দাবি।
পরিশেষে বলা যায়, ইসলামে সম্প্রীতি ও সহনশীলতার শিক্ষা শুধু ইসলামের অনুসারীদের জন্য নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির জন্যই একটি মূল্যবান সম্পদ। বর্তমান বৈশ্বিক সংঘাতের প্রেক্ষাপটে এই শিক্ষার যথাযথ বাস্তবায়ন করা গেলে, আমাদের পৃথিবী আরও শান্তিপূর্ণ ও সুখী হয়ে উঠবে। ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার উপর নির্ভর করে ধর্মীয় সহনশীলতা এবং শান্তির বার্তা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ুক – এই হোক আমাদের সবার প্রত্যাশা।
খাজা মোহাম্মদ মুস্তাকিম, সহযোগী অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ, হাবীবুল্লাহ্ বাহার কলেজ, ঢাকা।
সহযোগী অধ্যাপক, মার্কেটিং
হাবীবুল্লাহ্ বাহার কলেজ, ঢাকা।