ইসলাম একটি সামগ্রিক জীবনব্যবস্থা, যা মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খল দিকনির্দেশনা প্রদান করে। এর মধ্যে বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে নৈতিকতা এবং নেতৃত্বের উপর। ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে নৈতিকতা ও নেতৃত্ব কেবলমাত্র ব্যক্তিগত এবং সামাজিক উন্নয়নের জন্যই নয়, বরং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শান্তি, সাম্য এবং সঠিক বিচারের ভিত্তি গঠনের জন্য অপরিহার্য। এই নিবন্ধে ইসলামের আলোকে নেতৃত্ব এবং নৈতিকতার ভূমিকা ও গুরুত্ব, এবং আধুনিক সমাজে এর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আলোচনা করা হবে।
ইসলামের ইতিহাসে নৈতিকতার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কুরআন ও হাদীসে নৈতিকতার অনুশীলন এবং এর গুরুত্ব সম্পর্কে অসংখ্যবার আলোচনা করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, “তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম, যার চরিত্র উত্তম” (সহীহ বুখারী)। এই হাদীস থেকে স্পষ্ট যে, ইসলামের মতে নৈতিকতা একটি মৌলিক গুণ, যা কেবল ব্যক্তিগত আচরণের মাধ্যমেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং সামগ্রিকভাবে একজন ব্যক্তির সমাজে আচরণ ও নেতৃত্ব প্রদানে গভীর প্রভাব ফেলে। রাসূল (সা.)-এর পুরো জীবনটাই নৈতিকতার চরম উদাহরণ। তিনি ছিলেন সত্যনিষ্ঠ, সদয়, ধৈর্যশীল এবং অন্যের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গকারী নেতা, যিনি ব্যক্তিগত লাভের জন্য নয়, বরং মানুষের কল্যাণ এবং ন্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠা করার জন্য নেতৃত্ব দিয়েছেন।
ইসলামে নেতৃত্বের ধারণা অন্য যেকোনো সাধারণ নেতৃত্বের ধারণার চেয়ে বেশ ভিন্ন। নেতৃত্ব মানে শুধুমাত্র ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব নয়, বরং দায়িত্ববোধ ও আল্লাহর প্রতি জবাবদিহিতা। ইসলামে নেতা হতে হলে প্রথমত, তাকে নৈতিকভাবে দৃঢ় হতে হবে। নেতার উপর নির্ভর করে সমাজের নৈতিক মান। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেন, “তোমরা সৎকর্মের আদেশ দাও এবং অসৎকর্ম থেকে বিরত রাখো” (সূরা আল-ইমরান)। এই আদেশ স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে, নেতৃত্ব কেবলমাত্র পরিচালনার বিষয় নয়, বরং সঠিক পথ নির্দেশনার দায়িত্বও এর অন্তর্ভুক্ত।
আধুনিক সমাজে নেতারা নানা ধরণের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন। বর্তমান বিশ্বের জটিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সৎ, নৈতিক এবং দূরদর্শী নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা আরও বেশি অনুভূত হচ্ছে। দুর্নীতি, অন্যায় এবং অসাম্যের কারণে সমাজে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়, যা শুধুমাত্র নৈতিক নেতৃত্বের মাধ্যমেই প্রতিরোধ করা সম্ভব। ইসলামী নেতৃত্বের একটি মূল বৈশিষ্ট্য হলো তার উদারতা ও সাম্য। এক্ষেত্রে হজরত উমর (রা.)-এর শাসনকাল একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। তিনি নেতৃত্বের ক্ষেত্রে সততা, ন্যায়বিচার এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন। উমরের (রা.) নেতৃত্বে সকল শ্রেণীর মানুষ সমান অধিকার ভোগ করত এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল।
ইসলামের দৃষ্টিতে একজন নেতার প্রথম এবং প্রধান গুণ হলো তাকওয়া বা আল্লাহভীতি। এটি একজন নেতাকে আত্মনিয়ন্ত্রণ ও ন্যায়বিচারের পথে পরিচালিত করে। তাকওয়া ছাড়া কোনো নেতাই দীর্ঘমেয়াদে সফল হতে পারে না, কারণ সে আল্লাহর সামনে জবাবদিহির জন্য সর্বদা সচেতন থাকে। বর্তমান সমাজে যেখানে ক্ষমতার অপব্যবহার ও অন্যায় শাসনব্যবস্থা সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে ইসলামের এই নীতি খুবই প্রাসঙ্গিক।
সমসাময়িক সমাজে ইসলামের নেতৃত্বের মডেল প্রয়োগ করতে হলে প্রথমে আমাদের নিজেদের মধ্যে নৈতিকতার চর্চা করতে হবে। সমাজের নেতৃত্বের ক্ষেত্রে দায়িত্বশীলতা এবং মানবতার প্রতি দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি করতে হবে। ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী, একমাত্র সেই ব্যক্তিই নেতৃত্বের যোগ্য, যে তার নিজের নৈতিক চরিত্রের মাধ্যমে মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে পারে। আজকের বিশ্বে যেখানে নেতৃত্ব প্রায়শই ব্যক্তিগত স্বার্থে পরিচালিত হয়, সেখানে ইসলামের শিক্ষা অনুসারে নেতৃত্বের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত সমাজের কল্যাণ সাধন এবং দায়িত্বশীল আচরণ।
ইসলামের নেতৃত্বের অন্যতম গুণ হলো সহানুভূতি ও মানবিকতা। রাসূলুল্লাহ (সা.) তার জীবনে এ গুণগুলোর অনুশীলন করে দেখিয়েছেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সহানুভূতিশীল এবং মানবতার প্রতি গভীর ভালোবাসায় উদ্বুদ্ধ। নেতৃত্বের ক্ষেত্রে তিনি কখনো কঠোরতা প্রদর্শন করেননি, বরং দয়াশীলতা এবং ক্ষমার মাধ্যমে নেতৃত্ব দিয়েছেন। একবার, তায়েফে তাকে অপমান ও পাথর নিক্ষেপের শিকার হতে হয়েছিল, কিন্তু তিনি তাদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। এই ঘটনা থেকে বুঝা যায়, নেতৃত্বের অন্যতম গুণ হলো ক্ষমাশীলতা, যা সমাজে শান্তি ও সৌহার্দ্যের পরিবেশ সৃষ্টি করে।
আধুনিক সমাজে যদি ইসলামের নেতৃত্বের এই নীতিগুলো অনুসরণ করা হয়, তবে অনেক সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে। বর্তমান সময়ে নেতৃত্বের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে একটি হলো মানুষের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জন করা। ইসলামী নেতৃত্বের মডেল এমন একটি দৃষ্টান্ত যেখানে নেতৃত্বের প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস সর্বোচ্চ স্থানে থাকে, কারণ এ ধরনের নেতৃত্ব সৎ, নৈতিক এবং মানবকল্যাণে নিবেদিত। রাসূল (সা.) এবং তার সহচরদের নেতৃত্বের কালে সমাজে এই আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটেছিল।
ইসলামে নেতৃত্বের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো শূরা বা পরামর্শ গ্রহণ। এটি একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া যেখানে নেতা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় সমাজের সুধীজনদের পরামর্শ নেন। এই প্রক্রিয়া নেতৃত্বকে আরও শক্তিশালী এবং সঠিক পথে পরিচালিত করে। বর্তমান সময়ে নেতৃত্বের ক্ষেত্রে অনেক দেশ ও প্রতিষ্ঠান এই নীতিটি অনুসরণ করছে, যা ইসলামের শিক্ষা থেকে উদ্ভূত। শূরা ব্যবস্থা সমাজে মতামতের বহুমাত্রিকতা এবং পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতার মনোভাব গড়ে তোলে।
ইসলামের নেতৃত্ব এবং নৈতিকতার শিক্ষা আধুনিক সমাজে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। ইসলামের শিক্ষাগুলো যদি আমরা আমাদের ব্যক্তি জীবন ও সামাজিক জীবনে প্রয়োগ করতে পারি, তবে আমরা একটি ন্যায়বিচারমূলক, শান্তিপূর্ণ এবং সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে তুলতে পারবো। নেতৃত্বের ক্ষেত্রে ইসলামের আদর্শ শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, বরং বিশ্বব্যাপী মানবতার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা হতে পারে।
সহযোগী অধ্যাপক, মার্কেটিং
হাবীবুল্লাহ্ বাহার কলেজ, ঢাকা।