ইসলাম ও ধর্ম ডেস্ক, আজনিউজ২৪: ইসলামের দৃষ্টিতে দুর্নীতি করে মানুষের সম্পদ লুণ্ঠন করা জঘন্যতম অপরাধ। পবিত্র কোরআনে এ ব্যাপারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা এসেছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের অর্থ সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না এবং মানুষের ধন-সম্পত্তির কিছু অংশ জেনে-বুঝে অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে বিচারকদের কাছে পেশ কোরো না।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৮৮)
এ আয়াতটির এক অর্থ হচ্ছে, শাসকদের ঘুষ দিয়ে অবৈধভাবে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করো না। এর দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, তোমরা নিজেরাই যখন জানো এগুলো অন্যের সম্পদ, তখন শুধু তার কাছে তার সম্পদের মালিকানার কোনো প্রমাণ না থাকার কারণে অথবা একটু এদিক-সেদিক করে কোনো প্রকারে প্যাঁচে ফেলে তার সম্পদ তোমরা গ্রাস করতে পারো বলে তার মামলা আদালতে নিয়ে যেয়ো না। কেননা আদালত থেকে ওই সম্পদের মালিকানা অধিকার লাভ করার পরও প্রকৃতপক্ষে তুমি তার বৈধ মালিক হতে পারবে না। আল্লাহর কাছে তো তা তোমার জন্য হারামই থাকবে। অর্থাৎ দুর্নীতি করে দুনিয়ার আদালতকে ফাঁকি দিয়ে দুনিয়ার দৃষ্টিতে অন্যের সম্পদের বৈধ মালিক হওয়া সম্ভব হলেও মহান আল্লাহর দরবারে তা কখনো বৈধ বলে গণ্য হবে না। সুতরাং দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ হস্তগত করার কোনো সুযোগ ইসলামে নেই। তা ছাড়া দুর্নীতির মূল কারণ লোভ-লালসা। মানুষ লোভ-লালসা থেকে দুর্নীতিতে লিপ্ত হয়, যা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এগুলো মানুষের দ্বিন-ধর্মকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। কাব ইবনে মালেক আল-আনসারি (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, দুটি ক্ষুধার্ত নেকড়ে বাঘকে ছাগলের পালে ছেড়ে দেওয়া হলে পরে তা যতটুকু না ক্ষতিসাধন করে, কারো সম্পদ ও প্রতিপত্তির লোভ এর চেয়ে বেশি ক্ষতিসাধন করে তার ধর্মের। (তিরমিজি, হাদিস : ২৩৭৬)
সমাজের সবচেয়ে ভয়ানক ব্যাধি হলো দুর্নীতি, যা সমাজকে কলুষিত করে তাকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়। বৃহৎ পরিসরে ঘুষ প্রদান, সম্পত্তি আত্মসাৎ এবং সরকারি ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করাও দুর্নীতির অন্তর্ভুক্ত।
দুর্নীতি শব্দটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন এরিস্টটল। এরপর সিসারো দুর্নীতি শব্দটি ব্যবহার করেন, যিনি ঘুষ এবং সৎ অভ্যাস ত্যাগ প্রত্যয়ের যোগ করেছিলেন। রাষ্ট্র বিজ্ঞানের অধ্যাপক মরিস লিখেছেন, দুর্নীতি হলো ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ব্যবহার। অর্থনীতিবিদ আই. সিনিয়র এর ভাষ্যমতে, দুর্নীতি এমন একটি কার্য, যেখানে অনৈতিক অর্থ প্রদানের কারণে তৃতীয় কোনো পক্ষ সুবিধা পায়, যার ফলে তারা বিশেষ ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার নিশ্চিত করে, এতে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত পক্ষটি এবং তৃতীয় পক্ষ উভয়ই লাভবান হয় এবং এই কার্যে দুর্নীতিগ্রস্ত পক্ষটি থাকে কর্তৃপক্ষ।
তাই নিজের দ্বিন-ধর্ম বাঁচাতে হলে অবশ্যই লোভ-লালসা ত্যাগ করতে হবে। আর লোভ-লালসা ত্যাগ করা গেলে দুর্নীতিও কমে যাবে, ইনশাআল্লাহ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দুর্নীতিকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। একটি হচ্ছে সেবা খাতের দুর্নীতি, ঘুষ হিসেবে যেটি বর্ণনা করা যায়। এর ফলে যারা সেবা নিচ্ছেন, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, আর কর্মকর্তারা ঘুষ নিয়ে অর্থ সম্পত্তির মালিক হচ্ছেন। ইসলাম দুর্নীতির এই প্রকারকেও সমর্থন করে না। বরং ইসলামের দৃষ্টিতে এই প্রক্রিয়ায় দুর্নীতিতে লিপ্তদের অভিশপ্ত মনে করা হয়। কারণ হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, আব্দুল্লাহ ইবনে আস (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) ঘুষদাতা ও ঘুষগ্রহীতাকে অভিসম্পাত করেছেন। (আবু দাউদ, হাদিস : ৩৫৮০)
অর্থাৎ ইসলামের দৃষ্টিতে ঘুষদাতা ও গ্রহীতা উভয়ই সমান অপরাধী। উভয়ই দুর্নীতিবাজ। রাসুল (সা.) তাদের এই কাজে লিপ্ত নিকৃষ্ট মানুষদের অভিশাপ দিতে বাধ্য হয়েছেন।
আরেকটি দুর্নীতি হলো রুই-কাতলা দুর্নীতি বা বড় ধরনের দুর্নীতি, যা সম্পূর্ণ বান্দার হকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এর মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রীয় কেনাকাটা থেকে শুরু করে সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন, বাজেট বাস্তবায়ন ইত্যাদির মাধ্যমে যে দুর্নীতি হয়। বিশ্বের বড় বড় দেশেও এ ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ প্রায়ই ওঠে। অনেক ক্ষেত্রে এ ধরনের দুর্নীতি অবশ্য বড় বড় প্রাইভেট কম্পানিগুলোতেও হয়ে থাকে। কম্পানি পর্যায়ে এই দুর্নীতি কম্পানির মালিকের হকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। কোনোভাবে কম্পানির মালিকের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে পারলে হয়তো আল্লাহও মাফ করে দেবেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় দুর্নীতিগুলো রাষ্ট্রের সব নাগরিকের হকের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তা থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের সম্ভ্রমহানি বা অন্য কোনো বিষয়ে জুলুমের জন্য দায়ী থাকে, সে যেন আজই তার কাছ থেকে মাফ করিয়ে নেয় সেদিন আসার আগে, যেদিন তার কোনো দিনার বা দিরহাম থাকবে না। সেদিন তার কোনো সৎকর্ম না থাকলে তার জুলুমের পরিমাণ তা তার কাছ থেকে নেওয়া হবে, আর তার কোনো সৎকর্ম না থাকলে তার প্রতিপক্ষের পাপ থেকে নিয়ে তা তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে। (বুখারি, হাদিস : ২৪৪৯)
নাউজুবিল্লাহ! যারা দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎ করে, তারাও রাষ্ট্রের সব নাগরিকের ওপর জুলুম করে। কঠিন কিয়ামতের দিন তারা কতজন মানুষের ওপর জুলুমের প্রায়শ্চিত্ত করবে? কতজনের হক আদায় করতে সক্ষম হবে?
পৃথিবীতে দুর্নীতির শাখা-প্রশাখার অভাব নেই। কোনো দুর্নীতিই মানুষের ইহকাল-পরকালের জন্য কল্যাণকর নয়; বরং সব দুর্নীতিই মানুষের ইহকাল-পরকাল ধ্বংস করে দেয়। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে হিদায়াত দান করুন।
সূত্র : দৈনিক কালের কণ্ঠ