জয়নাব বিনতে আলী ছিলেন নবীজির (সা.)-এর নাতনি, ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদ (রা.) ও আলী ইবনে আবি তালিব (রা.)-এর কন্যা। তিনি আহলে বাইতের একজন বিশিষ্ট নারী, যিনি ইতিহাসের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে অটল অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন।
তাঁর জীবন ও বাগ্মিতা আমাদের শিক্ষা দেয় কীভাবে প্রতিকূলতার মুখেও সাহস ও ইমানের সঙ্গে সত্যের পক্ষে কথা বলতে হয়।
নবীযুগে জন্ম
তিনি ছিলেন নবীনন্দিনী ফাতিমা (রা.) ও আলী (রা.)-এর তৃতীয় সন্তান। হাসান ও হোসেন তাঁর বড় ভাই। নবীজির (সা.)-এর ওফাতের সময় জয়নাবের বয়স ছিল মাত্র পাঁচ বছর।
তিনি জন্মগ্রহণ করেন নবীজির যুগেই ৫ হিজরিতে। হুদায়বিয়ার সন্ধির আগে যখন মুসলমানরা মক্কায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন। নবীজি (সা.) নিজে তাঁর নামকরণ করেন নিজ কন্যা ও জয়নাবের খালা জয়নাব বিনতে মুহাম্মদ (রা.)-এর নামানুসারে।
তিনি ছিলেন নবীনন্দিনী ফাতিমা (রা.) ও আলী (রা.)-এর তৃতীয় সন্তান। হাসান ও হোসেন তাঁর বড় ভাই। নবীজির (সা.)-এর ওফাতের সময় জয়নাবের বয়স ছিল মাত্র পাঁচ বছর।
বিয়ে
জয়নাবের জীবন ছিল সরলতা, পবিত্রতা এবং জ্ঞানের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি তাঁর চাচাতো ভাই আবদুল্লাহ ইবনে জাফর ইবনে আবি তালিবের (রা.) সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। জাফর ছিলেন নবী (সা.)-এর পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত একজন সম্মানিত ব্যক্তি। তিনি তাঁর সম্পদ দিয়ে দরিদ্র, এতিম ও অসহায় নারীদের জন্য আশ্রয়স্থল তৈরি করেছিলেন।
জয়নাব ছিলেন কোরআনের হাফেজা। তিনি মদিনা ও পরে কুফায় নারীদের জন্য ধর্মীয় শিক্ষার ক্লাস পরিচালনা করতেন। তাঁর থেকে ইবনে আব্বাস (রা.) তাঁর হাদিস বর্ণনা করেছেন। তাঁর ভাই জয়নুল আবেদিন তাঁকে ‘আলিমা গায়র মুয়াল্লামা’ (যিনি শিক্ষা না নিয়েও জ্ঞানী) হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি ছিলেন ইবাদতপরায়ণ নারী, রাত জেগে নামাজ আদায় করতেন এবং দিনে রোজা রাখতেন।বিক্ষুব্ধ সময়ে জয়নাবের ভূমিকা
তখনকার রাজনৈতিক অস্থিরতা জয়নাবের জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। তাঁর পিতা আলী (রা.)-এর খিলাফতের সময় এবং পরবর্তী সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলি তাঁকে একটি কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি করে।
তাঁর পিতার হত্যা, ভাই হাসানের মৃত্যু এবং মুয়াবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ানের খিলাফতের সময়কার অস্থিরতা তাঁকে একটু একটু করে আহত করে। মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়ার খলিফা হওয়ার পর পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে।
হুসাইন ইবনে আলী (রা.) তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মদিনা থেকে মক্কায় এবং পরে কুফার দিকে যাত্রা করেন, যেখানে কুফার জনগণ তাঁর প্রতি আনুগত্যের শপথ করেছিল। জয়নাব তাঁর সন্তানদের নিয়ে এই যাত্রায় সঙ্গী হন।
কুফায় পৌঁছে তাঁরা দেখতে পান যে ১২ হাজার লোকের শপথ সত্ত্বেও মাত্র শতাধিক লোক তাঁদের পাশে রয়েছে। এরপর তাঁরা কারবালার নির্জন প্রান্তরে পৌঁছান, যেখানে ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়া ইবনে জিয়াদের নেতৃত্বে ৪ হাজার সৈন্যের একটি সেনাবাহিনী পাঠান। কারবালার যুদ্ধে হোসেন ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা শাহাদাত বরণ করেন এবং তিনিসহ বেঁচে থাকা নারী ও পুরুষকে ইবনে জিয়াদের দরবারে হাজির করা হয়।
কারবালার যুদ্ধে হোসেন ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা শাহাদাত বরণ করেন এবং তিনিসহ বেঁচে থাকা নারী ও পুরুষকে ইবনে জিয়াদের দরবারে হাজির করা হয়।
জয়নাবের সাহসিকতা
ইবনে জিয়াদের দরবারে জয়নাবের আচরণ ছিল মর্যাদাপূর্ণ এবং অটল। ইবনে জিয়াদ তাঁকে দেখে বললেন, ‘এই নারী কে?’ তাঁর দাসী উত্তর দিলেন, ‘এই হলেন জয়নাব, ফাতিমার কন্যা, আল্লাহর রাসুলের দৌহিত্রী।’
ইবনে জিয়াদ উপহাস করে বললেন, ‘আল্লাহর শুকরিয়া, যিনি তোমাদের অপমানিত ও নিহত করেছেন।’
জয়নাব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জবাব দিলেন: ‘বরং আল্লাহর শুকরিয়া, যিনি তাঁর নবীর মাধ্যমে আমাদের সম্মানিত করেছেন এবং অপবিত্রতা থেকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করেছেন। আল্লাহ কেবল নৈতিকভাবে দুর্নীতিগ্রস্তদের অপমান করেন এবং পাপীদের প্রত্যাখ্যান করেন, আর তারা আমরা নই।’ইবনে জিয়াদ তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার পরিবারের সঙ্গে আল্লাহ কী করেছেন, তা তুমি কীভাবে দেখছ?’ জয়নাব অটলভাবে বলেন: ‘তাদের জন্য মৃত্যু নির্ধারিত ছিল, তাই তারা তাদের বিশ্রামের স্থানে গিয়েছেন। আল্লাহ তাদের ও তোমাদের মধ্যে একটি সমাবেশ ঘটাবেন, এবং কিয়ামতের দিন তুমি তাঁর সামনে তাদের সঙ্গে বিতর্ক করবে।’
ইবনে জিয়াদ তখন জয়নুল আবেদিনের দিকে মনোযোগ দেন এবং তাঁকে হত্যা করতে বলেন। জয়নাব তৎক্ষণাৎ ভাইয়ের ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘যদি তা–ই হয়, তবে আমাকেও তার সঙ্গে হত্যা করো।’
এতে ইবনে জিয়াদ পিছু হটতে বাধ্য হয়, কারণ একজন নিরস্ত্র নারীকে হত্যা করা তার খ্যাতির জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
আমার পিতা, ভাই ও দাদার ধর্মের মাধ্যমেই তুমি, তোমার পিতা ও তোমার দাদা হেদায়েত পেয়েছিলে।
ইয়াজিদের সামনে জয়নাব বিনতে আলী (রা.)
ইয়াজিদের দরবারে
পরে জয়নাব ও তাঁর পরিবারকে ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়ার দরবারে সিরিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ইয়াজিদের একজন সঙ্গী জয়নাবের ভাইয়ের মেয়ে ফাতিমা বিনতে হুসাইনকে ‘উপহার’ হিসেবে দাবি করেন। জয়নাব রুষ্ট হয়ে বললেন: ‘এটা তোমার বা তার অধিকার নয়।’
ইয়াজিদ বললেন, ‘তুমি মিথ্যা বলছ। এটা আমার অধিকার এবং আমি চাইলে তা করতে পারি।’
জয়নাব দৃঢ়ভাবে বললেন: ‘না, আল্লাহর কসম, আল্লাহ তোমাকে এই অনুমতি দেননি, যদি না সে আমাদের ধর্ম ত্যাগ করে এবং অন্য ধর্ম গ্রহণ করে।’
ইয়াজিদ ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, ‘তুমি কীভাবে আমার সঙ্গে এমন কথা বলার সাহস করো। ধর্ম ত্যাগ করেছে তোমার পিতা ও ভাই।
জয়নাব শান্তভাবে কিন্তু দৃঢ়তার সঙ্গে জবাব দেন: ‘আমার পিতা, ভাই ও দাদার ধর্মের মাধ্যমেই তুমি, তোমার পিতা ও তোমার দাদা হেদায়েত পেয়েছিলে।’
এভাবে ইয়াজিদের সামনে তাঁর বক্তব্য হয়ে ওঠে জুলুমের বিরুদ্ধে একটি চিরন্তন প্রতিবাদ।
সূত্র: অ্যাবাউট ইসলাম ডটনেট