যখন পাপের অন্ধকার হৃদয়কে গ্রাস করে, যখন ভুলের বোঝা কাঁধে চেপে বসে, তখন একটি নাম আশার আলো জ্বালায়, ‘আল-গাফফার’। তিনি আল্লাহ, যিনি তাঁর অসীম ক্ষমায় বান্দার পাপ ঢেকে দেন, তাঁর রহমতের চাদরে তাকে আগলে রাখেন।
তাঁর ক্ষমার দরজা সব সময় খোলা, তাঁর রহমতের সমুদ্র কখনো শুকায় না। ‘আল-গাফফার’ নামটি শুধু তাঁর ক্ষমার প্রকাশ নয়, বরং আমাদের নবজীবনের পথ দেখায় এবং তাঁর দিকে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানায়।
ক্ষমার অপরূপ রূপ
‘আল-গাফফার’ আল্লাহর সেই নাম, যা তাঁর অসীম ক্ষমা ও রহমতের কথা বলে। তিনি সেই সত্তা, যিনি বান্দার পাপ ঢেকে দেন, তাঁর দোষত্রুটি প্রকাশ করেন না। কোরআন মজিদে এই নাম পাঁচবার উল্লেখিত হয়েছে, প্রতিবারই তাঁর অপার ক্ষমার সাক্ষ্য বহন করে। সুরা নুহে বলা হয়েছে, ‘তোমরা তোমাদের প্রভুর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। নিশ্চয় তিনি অতি ক্ষমাশীল।’ (আয়াত: ১০)
আল্লাহ তাঁর বান্দার পাপ ঢেকে দেন, যেন অন্য কেউ তা জানতে না পারে। তিনি দুনিয়ায় পাপের শাস্তি থেকে রক্ষা করেন এবং আখিরাতে তাঁর ক্ষমায় বান্দাকে মুক্তি দেন।
ইমাম হিজাজি (রহ.), আন-নুর আল-আসনা, পৃ. ৫৭
ইমাম হিজাজি (রহ.) বলেন, ‘আল্লাহ তাঁর বান্দার পাপ ঢেকে দেন, যেন অন্য কেউ তা জানতে না পারে। তিনি দুনিয়ায় পাপের শাস্তি থেকে রক্ষা করেন এবং আখিরাতে তাঁর ক্ষমায় বান্দাকে মুক্তি দেন।’ (আন-নুর আল-আসনা, পৃ. ৫৭)
তিনি শুধু পাপ ঢেকে দেন না, বরং তাঁর ক্ষমার মাধ্যমে বান্দার জীবনকে পবিত্র করেন। ক্ষমা ও ক্ষমতার অপূর্ব সমন্বয়
‘আল-গাফফার’ নামটি প্রায়ই ‘আল-আজিজ’ নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কোরআনে এসেছে। এই সংযোগ একটি গভীর তাৎপর্য বহন করে। আল্লাহ ‘আল-আজিজ’—সর্বশক্তিমান, যিনি সবকিছুর ওপর প্রভুত্বের অধিকারী। তিনি চাইলে বান্দাকে তার পাপের জন্য তৎক্ষণাৎ শাস্তি দিতে পারেন।
কিন্তু তিনি ‘আল-গাফফার’, যিনি তাঁর অসীম ক্ষমায় বান্দার দোষ ক্ষমা করেন। ‘তাঁর ক্ষমা দুর্বলতা থেকে নয়, বরং তাঁর শক্তি ও মহিমার প্রকাশ।’ (সাল্লাবি, কিসসাতু বাদ’ইল খালক, পৃ. ১১৪০)
তিনি সেই সত্তা, যিনি ক্ষমতা ও ক্ষমার মধ্যে অপূর্ব ভারসাম্য স্থাপন করেছেন।
স্তরের পর স্তর ক্ষমা
আল্লাহর ক্ষমা শুধু পাপ ঢেকে দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তিনি তাঁর বান্দার জন্য একাধিক স্তরে ক্ষমার ব্যবস্থা করেছেন।
প্রথমত, তিনি মানুষের শারীরিক ত্রুটিগুলো ঢেকে দিয়েছেন, যেন তার বাহ্যিক সৌন্দর্য প্রকাশ পায়।
তিনি সেই সত্তা, যিনি ক্ষমতা ও ক্ষমার মধ্যে অপূর্ব ভারসাম্য স্থাপন করেছেন।
দ্বিতীয়ত, তিনি মানুষের মনের নোংরা চিন্তা ও খারাপ ইচ্ছাগুলো হৃদয়ের গভীরে লুকিয়ে রেখেছেন, যেন অন্য কেউ তা জানতে না পারে।
তৃতীয়ত, তিনি বান্দার পাপ ক্ষমা করেন এবং তার তাওবার বিনিময়ে তার পাপকে পুণ্যতে রূপান্তরিত করেন। ‘তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যে বান্দা তাওবা করবে, তার পাপকে তিনি নেকিতে বদলে দেবেন।’ (আন-নুর আল-আসনা, পৃ. ৫৭)
গাফফার ও গাফুরের মধ্যে পার্থক্য
‘আল-গাফফার’ ও ‘আল-গাফুর’ নাম দুটি তাঁর ক্ষমার বিভিন্ন দিক প্রকাশ করে। ‘আল-গাফফার’ তিনি, যিনি বান্দার বারবার পাপ ক্ষমা করেন, পাপের সংখ্যা যতই হোক না কেন।
আর ‘আল-গাফুর’ তিনি, যিনি পাপের গুরুত্ব যত বড়ই হোক, তা ক্ষমা করেন। ‘আল-গাফফার পাপের পরিমাণের জন্য, আর আল-গাফুর পাপের প্রকৃতির জন্য।’ (আসমাউল্লাহিল হুসনা, মুকাদ্দিম, পৃ. ৫২) এই ক্ষমার সুসংবাদ মুমিনদের হৃদয়ে আশা জাগায়। যারা আল্লাহর প্রতি সুধারণা রাখে, যারা হতাশার পোশাক খুলে ফেলে, তারাই তাঁর ক্ষমার অধিকারী।
শায়খ আবদুর রহমান বিন সা’দি (রহ.), ফাতহুল বায়ান
তাওবার পথে ক্ষমার প্রতিশ্রুতি
আল্লাহর ক্ষমা তাঁর বান্দার তাওবার সঙ্গে জড়িত। তিনি বলেন, ‘যতবার বান্দা তাওবা করবে, ততবার আমি তাকে ক্ষমা করব।’
হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ বলেন, ‘হে আদম সন্তান, তুমি যতক্ষণ আমাকে ডাকবে এবং আমার কাছে আশা করবে, আমি তোমার সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করব, আমি এতে কোনো পরোয়া করি না। হে আদম সন্তান, যদি তোমার গুনাহ আকাশের শিখরে পৌঁছে যায়, তবু তুমি আমার কাছে ক্ষমা চাইলে আমি তোমাকে ক্ষমা করব।
হে আদম সন্তান, তুমি যদি পৃথিবীভর্তি গুনাহ নিয়ে আমার কাছে আসো, কিন্তু আমার সঙ্গে কাউকে শরিক না করে আমার সামনে হাজির হও, আমি তোমাকে পৃথিবীভর্তি ক্ষমা নিয়ে মিলিত হব।’ (তিরমিজি, হাদিস: ৩,৫৪০)
এই হাদিস আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে তাঁর ক্ষমার দরজা কখনো বন্ধ হয় না।
ক্ষমার পথে আশার আলো
শায়খ আবদুর রহমান বিন সা’দি (রহ.) বলেন, ‘এই ক্ষমার সুসংবাদ মুমিনদের হৃদয়ে আশা জাগায়। যারা আল্লাহর প্রতি সুধারণা রাখে, যারা হতাশার পোশাক খুলে ফেলে, তারাই তাঁর ক্ষমার অধিকারী।’ (ফাতহুল বায়ান, ১২/১২৮)
তিনি আরও বলেন, যারা মনে করে হতাশা ও নিরাশা বান্দার জন্য উপযুক্ত, তারা মহা ভুলের মধ্যে পড়ে। কারণ, আল্লাহ তাঁর কিতাবে এবং রাসুল (সা.) তাঁর সুন্নাহতে বান্দাদের আশার বাণী শুনিয়েছেন।
‘আল-গাফফার’ নামটি আমাদের জীবনে একটি আলোকবর্তিকা। যখন আমরা পাপের অন্ধকারে হারিয়ে যাই, তখন এই নাম আমাদের তাওবার পথ দেখায়। তাঁর ক্ষমা আমাদের হৃদয়ে শান্তি ফিরিয়ে আনে, আমাদের জীবনকে নতুন সম্ভাবনার দিকে নিয়ে যায়। তিনি সেই সত্তা, যিনি আমাদের দোষ ঢেকে দেন, আমাদেরকে তাঁর রহমতের ছায়ায় আশ্রয় দেন। তাঁর ক্ষমার সমুদ্রে ডুব দিয়ে আমরা পবিত্র হই, তাঁর প্রতি সম্পূর্ণ সমর্পণের মাধ্যমে শান্তি খুঁজে পাই।