মানুষ স্বভাবতই তার ভেতরের শূন্যতা পূরণের জন্য কিছু না কিছু খোঁজে। মুসলিম হোক বা অমুসলিম, সবাই এই শূন্যতা পূরণের একটি আকাঙ্ক্ষা অনুভব করে। কেউ ভালোবাসা, কেউ অর্থ, ক্ষমতা, খাবার, এমনকি মাদক বা ধ্বংসাত্মক আচরণের মাধ্যমে এই শূন্যতা পূরণের চেষ্টা করে।
কিন্তু আমরা এমনভাবে সৃষ্ট যে বস্তুগত জিনিস দিয়ে এই শূন্যতা পূরণ হয় না। কারণ মানুষের সৃষ্টি হয়েছে আধ্যাত্মিক সত্তা হিসেবে। আল্লাহ আমাদের এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন যাতে আমরা তাঁর নৈকট্য খুঁজি।
আল্লাহর নৈকট্যের অর্থ কী?
নৈকট্য মানে আল্লাহর কাছাকাছি যাওয়া। আল্লাহর নিকট পৌঁছানোর মাধ্যম হিসেবে পবিত্র কোরআনে ‘ওয়াসিলা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। বলা হয়েছে: “নেককারদের জন্য আমার পথনির্দেশ এবং আমার প্রভুর ওয়াসিলা রয়েছে, যেখানে নদী প্রবাহিত হয় এবং সেখানে তাদের চিরস্থায়ী আবাস।” (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৫)
ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেছেন, “ওয়াসিলা বলতে বোঝায় আল্লাহর নির্দেশিত বাধ্যতামূলক ও অতিরিক্ত কাজগুলো পালন করা। এই কাজগুলো নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর শিক্ষা দ্বারা সংজ্ঞায়িত।” (মাজমু‘আতুল ফাতাওয়া, দারুল ওয়াতান, রিয়াদ: ১৯৯৫, খণ্ড ১, পৃ. ১৮২)।
এই নৈকট্য আমাদের সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য। এটি আমাদের আধ্যাত্মিক শূন্যতা পূরণ করে এবং জীবনে শান্তি ও পরিপূর্ণতা নিয়ে আসে। নৈকট্য অর্জনের উপায়
আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য মহানবী (সা.)-এর শিক্ষা অনুসরণের বিকল্প নেই। নবীজির সুন্নাহর আলোকে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের কয়েকটি প্রধান উপায় হলো:
১. ফরজ কাজ সঠিকভাবে পালন করা : ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ—শাহাদাৎ, সালাত, জাকাত, রোজা ও হজ্জ—আমাদের আধ্যাত্মিক জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণ করে। খাদ্য, পানি বা বাসস্থানের অভাব পূরণের মতোই এই চাহিদাগুলো। ফরজ কাজ নিয়মিত পালন করা আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের প্রথম ধাপ।
২. নফল কাজ করা : ফরজের পাশাপাশি কিছু অতিরিক্ত কাজ আল্লাহর নৈকট্যে পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। এর জন্য বেশি সময় বা অর্থের প্রয়োজন নেই, শুধু নিয়ত ও সামান্য প্রচেষ্টা লাগেল যেমন:
দোয়া করা: যেকোনো পরিস্থিতিতে—হতাশা, আনন্দ, আশা বা দুঃখে—দোয়া করা আল্লাহর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে। নবীজি (সা.) বলেছেন, “দোয়া হলো ইবাদতের মূল।” (সুনান তিরমিজি, হাদিস: ৩৩৭১)।
ক্ষমা প্রার্থনা: নবীজি (সা.) প্রতিদিন বহুবার ক্ষমা প্রার্থনা করতেন, যদিও তিনি পাপমুক্ত ছিলেন (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৩০৭)। ইস্তিগফার পাপের বোঝা হালকা করে এবং আল্লাহর নৈকট্য বাড়ায়।
নিয়ত পুনর্নির্ধারণ: দৈনন্দিন কাজ, যেমন কাজ, পরিবারের জন্য খরচ বা গৃহস্থালির কাজ, আল্লাহর সন্তুষ্টির নিয়তে করলে তা ইবাদতে পরিণত হয়। যেমন: পরিবারের জন্য উপার্জন সাদাকাহ হিসেবে গণ্য হয় (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১০০২)। নৈকট্য অর্জনের পথে বাধা
আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের পথে বেশ কিছু বাধা রয়েছে। এগুলো চিহ্নিত করে সমাধান করা হলে আমাদের আধ্যাত্মিক যাত্রার পথ সহজ হবে। প্রধান বাধাগুলো হলো:
অনুপযুক্ত সঙ্গ: যার সঙ্গ আল্লাহকে ভুলিয়ে দেয়, তাদের সঙ্গে অতিরিক্ত সময় কাটালে আমরা পথহারা হতে পারি। একটি প্রবাদে বলা হয়েছে, “সত্যিকারের বন্ধু সেই, যে তোমার উপস্থিতিতে আল্লাহর কথা বলে এবং তোমার অনুপস্থিতিতে তোমার জন্য দোয়া করে।” (আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদিস: ২৮৪)।
নিরাশা: অনেকে মনে করেন তাদের পাপ এত বেশি যে তারা আল্লাহর নৈকট্যের অযোগ্য। এটি শয়তানের ফাঁদ। কোরআনে বলা হয়েছে, “বল, ‘হে আমার বান্দারা, যারা নিজেদের উপর অত্যাচার করেছে, আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব পাপ ক্ষমা করেন।’” (সুরা যুমার, আয়াত: ৫৩)।
আল্লাহর মহত্ত্ব না বোঝা: আমরা প্রায়ই স্ত্রী, সন্তান বা অর্থের প্রতি এত মনোযোগ দিই যে স্রষ্টাকে ভুলে যাই। আল্লাহর ৯৯টি নাম ও তাঁর গুণাবলি অধ্যয়ন করা তাঁর মহত্ত্ব উপলব্ধি করতে সাহায্য করে (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৭৩৯২)।আল্লাহর নৈকট্যের নিদর্শন
আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের কিছু আলামত আছে, যেমন:
আল্লাহর ভালোবাসা ও গ্রহণযোগ্যতা: নবীজি (সা.) বলেছেন, “যদি আল্লাহ কাউকে ভালোবাসেন, তিনি জিবরীলকে বলেন, ‘আমি অমুককে ভালোবাসি, তুমিও তাকে ভালোবাসো।’ জিবরীল তাকে ভালোবাসেন এবং আসমানের বাসিন্দাদের মাঝে ঘোষণা করেন। তখন পৃথিবীতে তার জন্য গ্রহণযোগ্যতা স্থাপিত হয়।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৭৪৮৫)।
ভালো মানুষের ভালোবাসা এই নৈকট্যের আলামত।
আল্লাহর স্মরণে আনন্দ: নৈকট্য অর্জনের ফলে বান্দা আল্লাহকে ঘন ঘন স্মরণ করেন এবং ইবাদত উপভোগ করেন। হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ বলেছেন, “যে আমার দিকে এক হাত এগিয়ে আসে, আমি তার দিকে দুই হাত এগিয়ে যাই; যে আমার দিকে হেঁটে আসে, আমি তার দিকে দৌড়ে যাই।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৭৪০৫)।
পরীক্ষার মাধ্যমে উন্নতি: নবীজি (সা.) বলেছেন, “যখন আল্লাহ কারো জন্য ভালো চান, তিনি তাকে পরীক্ষায় ফেলেন।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫৬৪৫)। দুঃখ বা সুখের পরীক্ষা আমাদের আল্লাহর কাছে কাছে নিয়ে যায়, যদি আমরা ধৈর্যশীল ও কৃতজ্ঞ থাকি।
মোটকথা: আল্লাহর নৈকট্য অর্জন আমাদের সৃষ্টির মূল লক্ষ্য। ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ, দুয়া, ইস্তিগফার ও নিয়ত পুনর্নির্ধারণের মাধ্যমে আমরা এই নৈকট্য অর্জন করতে পারি। অনুপযুক্ত সঙ্গ, নিরাশা এবং আল্লাহর মহত্ত্ব না বোঝার মতো বাধাগুলো সঠিক সঙ্গ, তওবা এবং আল্লাহর গুণাবলি অধ্যয়নের মাধ্যমে অতিক্রম করা যায়।