রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর জীবনী প্রথম পড়েছিলাম অনেক ছোটবেলায়—সিরাতে ইবনে হিশাম’। কিছু বুঝিনি, মনেও নেই। এটা বইয়ের দোষ না। যে বয়সে পড়েছি, সেটা চাচা চৌধুরী পড়ার বয়স, তাই। এরপর পড়েছিলাম ‘রাসুলুল্লাহ (সা)–এর বিপ্লবী জীবন’, ‘মানবতার বন্ধু’। ভালো লেগেছে, আলাদা আলাদা ঘটনাগুলো মনে আসত। আর সেসবের পেছনের দর্শন। এরপর পেলাম সেই বইটা।
‘আর রাহিকুল মাখতুম’। সিলমোহরকৃত অমৃত। আল্লামা সফিউর রহমান মোবারকপুরীর লেখা। আমি পড়েছি ‘আল কোরআন একাডেমি’র অনুবাদটি। ভূমিকাটা ভালো লাগল, একটা সিরাত প্রতিযোগিতার জন্য তাড়াহুড়ো করে লেখা বই। শুরু করলাম পড়া। কী আশ্চর্য একটা বই। এর শুরু আবরাহার আক্রমণ পূর্ব আরব। আরবের জাতিগত স্বাতন্ত্র্য, বৈশিষ্ট্য, শ্রেষ্ঠত্ব। আসমানি কিতাব যে জাতির কাছে আসবে, কিতাবের অনুসারীরা যাকে মনে গেঁথে নেবে, আবার বাস্তবায়ন করে উদাহরণ রেখে যাবে, কেমন হবে সেই জাতি? লোক দেখানো চকচকে সমাজব্যবস্থা থাকা লাগবে? নাকি যুদ্ধবাজ হতে হবে? আল্লাহ কেন আরবদের বেছে নিলেন? উন্নত নৈতিক মানসম্পন্ন এক জাতি, সাহিত্য আর ব্যবসায় যাদের সমান দখল, আর কে ছিল আরবরা ছাড়া? ইউরোপ তখন অন্ধকারে, রোম বা পারস্যে ফিকে রং, সভ্যতা অনাচারে রূপ নিয়েছে।
এমন সময় তিনি আসলেন। এক আশ্চর্য সুন্দর মানুষ, যাঁর নামই ‘প্রশংসিত’। দাদা আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ (সা.)–কে প্রাণে চেপে কাঁদতেন। এর মাথায় ছায়া নেই। না বাবা, না মা। যুবক মুহাম্মদ (সা.)–কে ব্যবসায় শ্রম দিতে হচ্ছিল, অন্যান্য যুবকের মতো শুয়েবসে থাকার সামর্থ্য নেই তাঁর। আল্লাহ কি অদ্ভুত এক পরিকল্পনাকারী। এই ব্যবসা মুহাম্মদ (সা.)–কে লোক চেনালো, তাঁকেও মানুষ চিনল, ‘বিশ্বাস’–এর দৃশ্যমান অবয়ব হয়ে উঠলেন। ইহুদি রাহেব বহিরা, আরব ব্যবসায়ীর মাথায় মেঘের ছায়া দেখে সিজদায় পড়লেন, তিনি এসে গেছেন। ধনাঢ্য বিধবা খাদিজার দাস, মাইসারা, বাণিজ্য সফর শেষে এসে শতবার বললেন, ‘মা, এ লোক অন্য রকম।’
আল্লাহর পরিকল্পনা কী চমকপ্রদ। যৌবনে মুহাম্মদ (সা.)–এর পাশে ছিলেন খাদিজা (রা.)। নিজের প্রজ্ঞা, সম্পত্তির পাহাড়, অনুগতদের ভিড়—সব নিয়ে। আর বার্ধক্যে আয়েশা (রা.)। ক্ষুরধার মেধা, স্মৃতিশক্তি দিয়ে রাসুলকে দেখেছেন, ছবি তুলে রেখেছেন, আর তাঁর চলে যাওয়ার পরে মানুষকে শিখিয়েছেন। কি বৈপরীত্য আল্লাহর সিদ্ধান্তে, অথচ কী পরিপাটি তাঁর পরিকল্পনা।
‘আর রাহিকুল মাখতুম’ পড়বেন, অথচ মুহাম্মদ (সা.)–এর দুনিয়া থেকে চলে যাওয়ার বর্ণনায় পৃষ্ঠাগুলো ভেজাবেন না, তা হবে না। উমর (রা.) হয়ে যাবেন, ‘কে বলেছে তিনি নাই, আসুক, মুণ্ডু নামিয়ে দেব।’ আবার আবু বাকর (রা.)–এর সঙ্গে উচ্চারণ করবেন, অবনত মস্তক আপনার চোখের পানিকে আড়ালে বইতে দেবে। ‘তিনি মানুষ, কিন্তু আল্লাহ অমর, অসীম, অনন্ত’।
সাহিত্যের বিচারে বইটা সুন্দর। আবার দার্শনিকদের চোখে হয়তো একটু কম তাত্ত্বিক। এই বইটা আমার মাথায় একটুখানি জায়গায় সিরাতকে এঁকে দিয়েছে। কোনটা আগে, কোনটা পিছে, কোন ঘটনার আড়ালে কী কারণ, মনে হয় যেন খুব তৃপ্তি নিয়ে ইতিহাসের পাতাগুলোয় হেঁটে এসেছি। বাংলায় আমাদের হাতে বই এসে পৌঁছানো পর্যন্ত যত মানুষের ভূমিকা, আল্লাহ সবাইকে তাঁদের নিয়তের বরকত দেবেন, ইনশা আল্লাহ।