আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মারপ্যাঁচে দেশের প্রথম বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) বিআরটি প্রকল্প এখন আইসিইউতে। আর এরই মধ্য দিয়ে আবারও অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে এই প্রকল্পের অত্যাধুনিক ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ১৩৭টি বাস কেনা। তবে কোমায় চলে যাওয়া জনগুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পটি জনগণের যাতায়াতের কষ্ট লাঘবে অর্ন্তবর্তী সরকারের ১৩৭টি বাস কেনার জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করার এখনই উপযুক্ত সময়।
তবে গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর সকাল ৮ টায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান প্রকল্পটির উদ্বোধন করেন।ওই সময় সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. এহছানুল হক জানান, এখনো পর্যন্ত প্রকল্পের ৯৮ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি কাজ বাস চলাচলের মধ্যেও চলমান থাকবে। আশা করছি, আগামী বছরের জুনে এই প্রকল্প পুরোপুরি শেষ হবে। সে অনুষ্ঠানেই বোঝা গেল সিনিয়র সচিবও জানেন না অনেক তথ্য।
এদিকে প্রকল্পটির বিভিন্ন দিকগুলো পাশ থেকে সবকিছুই বলে মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে বলে দিচ্ছেন বিআরটি প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনিরুজ্জামান। এরপর মো. এহছানুল হক বলেন, ‘সহজে কম সময়ে যেন চলাচল করতে পারে। ১০-১৫ টা দিবো। যদি চাহিদা বাড়ে আমরাও বাসের সংখ্যা বাড়াবো। বাসগুলো গুলিস্থান পর্যন্ত যাবে।’
প্রকল্পটির জানা অজানা তথ্য
অভিযোগ ৫শ কোটি টাকার এই প্রকল্পে একটি দরদাতা কোম্পানির সঙ্গে সাবেক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রীর পরিবারের লোকজন ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত রয়েছে। বিষয়টি প্রকল্পের সবাই জানেন। এছাড়া সাবেক প্রধানমন্ত্রীর এপিএস ও সাবেক সংসদ-সদস্য সাইফুজ্জামান শেখর, সাবেক নৌপরিবহণমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, লিয়াকত সিকদার ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য সাইদুর রহমান খানসংশ্লিষ্ট রয়েছেন। অভিযোগ আছে, এই সিন্ডিকেট স্থানীয় একটি কোম্পানির পক্ষে লবিস্ট হিসাবে কাজ করছে। একই সঙ্গে তাদের পক্ষে টেন্ডার আহ্বান করে চীনের তৈরি নিম্নমানের বাস প্রদানের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। বিআরটির একটি অসাধু চক্রও এর সঙ্গে জড়িত। এই অবস্থায় প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রকল্পের গুণগতমান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
কাজটিকে এগিয়ে নিতে উদ্যোগ
বাংলাদেশ সরকার ফ্রান্স সরকারের সফ্ট লোনে (AFD (Agence Française de Développement) বাংলাদেশের বিআরটি-৬ লাইনের (ঢাকা-গাজীপুর) জন্য ১৩৭টি ডিজেল বাসের ব্যবস্থা রেখে গত ২০১২ সালে প্রকল্পের অনুমোদন দেয়। প্রকল্পে বাস সার্ভিস শুরু হলে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো বিনাবাধায় যাত্রীগণ এসি বাসে চলাফেরা করতে পারতেন এবং এতে ঢাকা শহবের যানজট অনেকাংশে কমে যেত। এ সুবিধাসমূহ পেলে পুরনো বাসে না ওঠে যাত্রীসাধারণ এই বাস ব্যবহার করত এ আশঙ্কায় বাস মালিক সমিতি প্রকল্পের শুরু থেকেই প্রকল্পের বিরোধিতা করে আসছে। বাস মালিক সমিতির নেতা ছিলেন সাবেক ফ্যাসিস্ট সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট এনায়েত উল্লাহ।
প্রকল্প কর্তৃপক্ষ গত ২০২৩ সালের ১৪ জানুয়ারী ১৩৭টি এসি ডিজেল বাস ক্রয়ের নিমিত্ত দরপত্র আহ্বান করে বিআরটি কর্তৃপক্ষ। সাবেক সড়ক -জনপথমন্ত্রী-সচিব এবং শেখ সেলিম এই দুই পক্ষের মাঝে দ্বন্দ্বের কারণে দরপত্রটি বাতিল হয়ে যায়।
পরবর্তীতে সরকার এবং ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান এএফডি-এর অনুমোদনক্রমে কর্তৃপক্ষ গত বছরের ১০ জুন ২য় দরপত্র আহ্বান করে। এই দরপত্রে চীনা একটি কোম্পানির কিং লং বাস কোম্পানির দরপত্র টেকনিক্যাল এবং আর্থিকভাবে সর্বনিম্ন দরদাতা নির্বাচিত হয়। এই দরে কেনার জন্য প্রকল্প কর্তৃপক্ষ এবং ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান এএফডি তাদের বরাবরে কার্যাদেশ দিতে সুপারিশ করে। নিয়ম অনুযায়ী প্রকল্প কর্তৃপক্ষ প্রশাসনিক অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করে।
এই পর্যায়ে বাস মালিক সমিতি পত্রিকায় বিষয়টি নিয়ে নেগেটিভ রিপোর্ট করায় এবং সেই রিপোর্ট সংযুক্ত করে মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা রবাবরে বে-নামি একটি পত্র দেয়। সেই বে-নামি পত্রকে গুরুত্ব দিয়ে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ মন্ত্রনালয়ের ক্রয় নীতিমালা নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিওরমেন্ট অথরিটি (বিপিপিএ) সাবেক সিপিটিইউতে তাদের মতামতের জন্য চিঠি প্রেরণ করে। বিপিপিএ উক্ত বে-নামি পত্রকে গুরুত্ব না দিতে পরামর্শ দেয়।
বিশেষ বাস পরিচালনার জন্য ঢাকা বাস র্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিবিআরটিসিএল) গঠন করা হয়েছে। তারা বিমানবন্দর-গাজীপুর বিআরটি পথে বিশেষায়িত বাসসেবা ‘ঢাকা লাইন’ চালুর ঘোষণা দেয়। তবে ১৩৭টি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাস কেনার দরপত্র আহ্বান করেও তা পারেনি।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জনগণের নয় নিজেদের স্বার্থ হাসিলের এই প্রকল্প গাজিপুর এর গলার কাটা হয়ে থাকবে।
এতদসত্ত্বেও বিপিপিএ এর উক্ত মতামতসহ প্রশাসনিক অনুমোদনের জন্য দ্বিতীয় বার মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করে। সচিব মহোদয় আবার অধিক যাচাইয়ের জন্য বিষয়টি সাবেক সচিব, সাবেক মহা-পরিচালক BPPA এবং ক্রয় উপদেষ্টা ফারুক হোসেনের মতামতের জন্য প্রেরণ করে। সাবেক সচিব ফারুক হোসেন BRT প্রকল্প কর্তৃপক্ষের ক্রয় পদ্ধতি সঠিকভাবে পালন করা হয়েছে বলে মতামত দেয়।
প্রকল্প কর্তৃপক্ষ প্রশাসনিক অনুমোদনের জন্য ৩য়বার মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করে। সচিব কাজটি অধিক জটিল করার জন্য কি কি পদ্ধতি অবলম্বন করা যায় তার জন্য পথ খুঁজতে কাল ক্ষেপণ করেছেন।
চলমান দরপত্র প্রক্রিয়া বারবার বাতিল করলে আবারও BRT প্রকল্পটির সম্ভাবনাময় উন্নয়ন থেকে বর্তমান সরকার পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
গত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিজয় সরণির যানযট নিরসনে পুরাতন বিমান বন্দরের মধ্যে দিয়ে বাইপাস তৈরি করে দৃষ্টান্তমূলক কাজের প্রমাণ রেখেছে। ছাত্র জনতার এই বিপ্লবী সরকারের সফলতার পালক লাগাতে বিগত সরকারের সর্ষের মধ্যে কোন ভূত এই কাজের পিছনে আছে, কাজ না করে কাল ক্ষেপন করছে?
জানা যায়, প্রথম দরপত্রে ঝামেলা সৃষ্টিকারী শেখ সেলিমের প্রতিনিধিগণ এবং বাস মালিক সমিতির অশুভচক্র কেউ এর পেছনে আছে যারা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা সৃষ্টি করে ও পত্রিকায় ভুয়া খবর পরিবেশন করে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে সরকারের কাজে বাধা সৃষ্টি করে বর্তমান সরকার সম্পর্কে জনগণকে ভুলবার্তা দেওয়ার চেষ্টা করছে।
বিষয়টি নিয়ে প্রকল্প পরিচালক মনিরুজ্জামান এবং ক্রয়কারী মহিউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা এ বিষয়ে কোনো প্রকার মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। গত ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে বাস মালিক সমিতির মহাসচিব এনায়েত উল্লাহ পলাতক থাকায় এবং বর্তমান কোনো সমিতি সক্রিয় না থাকায় তাদের বক্তব্য নেওয়া যায়নি।
প্রসঙ্গত, ২০১২ সালের ১ ডিসেম্বর বিআরটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। শুরুতে ব্যয় ধরা হয় ২ হাজার ৩৯ কোটি ৮৪ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে। এরপর কয়েক দফা সময় বাড়িয়ে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর নির্ধারণ করা হয়েছিল। সবশেষ বলা হয়েছিল চলতি বছরের আগস্টে কাজ শেষ হবে। পরে সরকার ডিসেম্বরে উদ্বোধনের কথা জানায়। এর মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় বিআরটি প্রকল্পে ব্যাপক ভাঙচুর করা হয়। ফলে প্রকল্পের উদ্বোধন নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল। বিআরটি প্রকল্পে বলা হয়েছিল, বিআরটি বাস্তবায়িত হলে ১০০টি আর্টিকুলেটেড বাসের মাধ্যমে প্রতি ঘণ্টায় ২৫ হাজার মানুষ যাতায়াত করবে।
আর্টিকুলেটেড বাসের চাহিদা কেন?
প্রকল্পে মতে বিআরটি (https://en.wikipedia.org/wiki/Dhaka_BRT?wprov=sfla1) কর্তৃক ঘন্টায় ২৫,০০০ যাত্রী পরিবহনের এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য দূষণ বিহীন পরিবেশে চলাচলের উপযোগী ১৮৭টি বিদ্যুৎ চালিত বাস কেনার প্রস্তুতি নেওয়া হয়। ইতোমধ্যে দেশে বিদ্যুৎ এর অপ্রতুলতা দেখা দেওয়ায় বিদ্যুৎ চালিত বাসের বদলে আর্টিকুলেটেড বাস (ট্রেনের বগি সদৃশ্য https://en.wikipedia.org/wiki/Articulated_bus?wprov=sfla1) কেনার পরিকল্পনা করা হয়। পরিবহন বিশেষজ্ঞদের মতে আর্টিকুলেটেড বাসের জন্য যে প্রশস্ত রাস্তার প্রয়োজন, তা না থাকায় ১৩৭টি ডিজেল বাস এবং ৫০টি বিদ্যুৎ চালিত বাস কেনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়।
কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং সাবেক ফ্যাসিস্ট সরকারের ভূত এখনও সরকারের মধ্যে ঘাপটি মেরে কাজ চালিয়ে ২ বার টেন্ডার করে এই স্বপ্নের প্রকল্পটি ঝুলিয়ে রাখছে, যার ফলে ১২ বছরেও গণপরিবহনের এই যুগান্তকারী ব্যবস্থা এখন আইসিইউতে। সচেতন মহলের ইচ্ছা সত্যিকারের কোন দেশপ্রেমিক এই আইসিইউতে থাকা বিআরটিকে সুস্থ জীবন দান করে।