প্রকট ডলার সংকটে কঠোরভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে ডলারের দাম। গত দেড় বছর ধরে নিয়ন্ত্রণ করায় ভোগ্যপণ্যসহ শিল্প ও বাণিজ্যিক খাতের পণ্য আমদানি কমে গেছে।
এর প্রভাবে বাজারে এসব পণ্যের দাম বেড়েছে। প্রায় সব খাতেই নেতিবাচক পরিস্থিতি অর্থাৎ একরকম স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। নতুন শিল্পের গতি স্থবির হয়ে পড়েছে। আমদানি নির্ভর শিল্পের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। এতে নতুন কর্মসংস্থানের গতিও থমকে গেছে।
অনেক কর্মী বেকার হয়ে পড়েছেন। ফলে মানুষের আয় কমেছে। অন্যদিকে পণ্যের দাম বাড়ায় মানুষের ব্যয় বেড়েছে। ডলার সংকটের প্রভাবে স্বল্প ও মধ্য আয়ের মানুষের জীবনে নেমে এসেছে বড় ধরনের দুর্ভোগ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে ডলারের দাম ছিল গড়ে ৮৪ টাকা ৫০ পয়সা। এখন ডলারের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১১ টাকা। আলোচ্য সময়ে ডলারের দাম বেড়েছে ২৬ টাকা ৫০ পয়সা। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিশেষ করে বাণিজ্যিক আমদানিকারকরা এই দামে ডলার পাচ্ছেন না। তাদেরকে আরও বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে। ফলে আমদানি ব্যয়ও বেড়ে গিয়ে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে।
এতে বেড়ে যাচ্ছে মূল্যস্ফীতির হার। অক্টোবরে এ হার বেড়ে প্রায় ১০ শতাংশের কাছাকাছি চলে গেছে। এর মধ্যে খাদ্যপণ্যের দাম বেশি বাড়ায় এ খাতে মূল্যস্ফীতির হার সাড়ে ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।
ডলার সংকট মোকাবিলায় গত বছরের এপ্রিল থেকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। জুনে নিয়ন্ত্রণ আরও কঠোর করা হয়। আগস্টে ডলারের সংস্থান ছাড়া এলসি খোলা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে রপ্তানিকারক ও অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের এলসি খোলা যাচ্ছিল। বাণিজ্যিকভাবে পণ্য আমদানির এলসি খোলা ভয়ানকভাবে কমে যায়।
এর প্রভাবে আমদানি নির্ভর শিল্পে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এসব পণ্যের দাম বাড়ার পাশাপাশি এসব শিল্পে এখন কাঁচামাল সংকটে পণ্যের উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে এসব শিল্পে বড় ধরনের সংকট দেখা দিয়েছে। অনেক শিল্প কাঁচামাল সংকটে বন্ধের উপক্রম হয়েছে। এগুলোতে কর্মরত শ্রমিকরাও চাকরিচ্যুত হয়েছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত অর্থবছরে বাণিজ্যিক শিল্প খাতের পণ্য ও কাঁচামালের আমদানি ও এলসি খোলা দুটিই কমেছিল। চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরেও এ খাতে আমদানি কমেছে ১৪ শতাংশ, শিল্প খাতের কাঁচামাল আমদানি কমেছে সাড়ে ১৪ শতাংশ। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এ খাতে এলসি খোলার হার সামান্য বেড়েছে।
বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি শিল্পগুলো নিজেরা কাঁচামাল পণ্য আমদানি করতে পারে না। তারা পাইকারি বাজার থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে উৎপাদন করে। এ খাতের চাহিদার জোগান দিতে বাণিজ্যিক আমদানিকারকরা শিল্পের কাঁচামাল আমদানি করেন। কিন্তু ডলার সংকটে এ খাতের আমদানি গত দেড় বছর ধরে কমছে। এতে এসব শিল্প বড় ধরনের সংকটে পড়েছে।
বৈশ্বিক মন্দায় রপ্তানি শিল্পেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। গত জুনের পর থেকে রপ্তানি আয় কমছে। জুনে সর্বশেষ ৫০০ কোটি ডলারের বেশি আয় হয়েছিল। এরপর থেকে তা কমে গত অক্টোবরে আয় এসেছে ৩৭৬ কোটি ডলার। রপ্তানি শিল্পের কাঁচামাল আমদানি করা হয় ব্যাক টু ব্যাক এলসির মাধ্যমে। গত অর্থবছরে এ খাতে আমদানির পাশাপাশি এলসিও কমেছে।
চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে এ খাতের ব্যাক টু ব্যাক এলসি কমেছে সাড়ে ১০ শতাংশ, আমদানি কমেছে ২৯ শতাংশ। এর প্রভাবে রপ্তানি পণ্যের উৎপাদন কম হবে। ফলে রপ্তানি কমবে। একই সঙ্গে কমে যাবে রপ্তানি আয়। ইতোমধ্যে রপ্তানি খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে মুজুরি বাড়ানোর দাবিতে শ্রমিক অসন্তোষ। এতে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এতেও উৎপাদন বাধাগ্রস্থ হচ্ছে।
শিল্পের অন্যতম উপকরণ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ। এ খাতেও আমদানি কমেছে। জ্বালানি তেল আমদানি কমায় বিদ্যুতের উৎপাদনও কমে গেছে। এতে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। ফলে উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। একই সঙ্গে গ্যাসের আমদানিও কম। চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে জ্বালানি পণ্যের এলসি কমেছে সাড়ে ১২ শতাংশ, আমদানি কমেছে ২০ শতাংশ।
এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে শিল্প খাতে। একই সময়ে জ্বালানির অন্যতম উপকরণ কয়লার আমদানি বাড়লেও এলসি খোলা কমে গেছে। আগে আমদানি করা কয়লার এলসির দায় পরিশোধ করতে না পারায় নতুন এলসি কমে গেছে। আলোচ্য সময়ে কয়লার এলসি কমেছে ৪৬ দশমিক ৬৯ শতাংশ। আমদানি বেড়েছে ১১৯ দশমিক ৪৫ শতাংশ।
বাড়তি আমদানির দায় পরিশোধে এখন সংস্থাগুলো হিমশিম খাচ্ছে। ডলার সংকটে তারা এগুলোর দায় পরিশোধ করতে পারছে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ডলার সংকটের কারণে গত অর্থবছরের মতো চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরেও শিল্পের মৌলিক কাঁচামালে আমদানি ও এলসি খোলা দুটোই কমেছে। এলসি খোলা কমায় আগামীতেও এসব পণ্যের আমদানি কমবে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৩ মাসে শিল্পের কাঁচামালের এলসি কমেছে সাড়ে ২২ শতাংশ। একই সঙ্গে আমদানি কমেছে প্রায় ৩৭ শতাংশ।
শিল্পের কাঁচামালের আমদানি কমায় এ খাতের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক মন্দায় মানুষের আয় কমায় ও ডলারের দাম বাড়ায় পণ্যের দাম লাগামহীনভাবে বেড়ে যাওয়ায় মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে গেছে। ফলে মানুষ খাদ্যের চাহিদায় কাটছাঁট করেছে। ফলে পণ্যের বিক্রিও কমে গেছে। এতে উৎপাদনও কমছে।
অনেক প্রতিষ্ঠান শিল্পের মধ্যবর্তী কাঁচামাল আমদানি করে সেগুলো দিয়ে ফিনিশড পণ্য উৎপাদন করে বাজারজাত করে। এ খাতের কাঁচামাল আমদানিও কমেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৩ মাসে শিল্পের মধ্যবর্তী কাঁচামালের মধ্যে এলসি খোলা কমেছে ২৮ শতাংশ ও আমদানি কমেছে ১৬ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে শিল্পের মৌলিক কাঁচামালের মধ্যে অপরিশোধিত ভোজ্যতেলের এলসি কমেছে ৮৭ দশমিক ৪০ শতাংশ, আমদানি কমেছে ৭২ দশমিক ৭১ শতাংশ। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে এর দাম কমায় আমদানি কমেছে। পাশাপাশি চাহিদা কমা ও ডলার সংকটেও আমদানিতে লাগাম পড়েছে।
বস্ত্র খাতের খাতের কাঁচামাল টেক্সটাইল ফেব্রিক্স আমদানির এলসি কমেছে ২০ দশমিক ২১ শতাংশ ও আমদানি কমেছে ২৮ দশমিক ০৯ শতাংশ। তুলা আমদানির এলসি কমেছে ২ দশমিক ৯৭ শতাংশ, আমদানি কমেছে ৩৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ। সিনথেটিক ফাইবার আমদানির এলসি কমেছে ২ শতাংশ, আমদানি কমেছে ৩৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। অর্থাৎ বস্ত্র খাতের সব উপকরণের আমদানিতেও মন্দা দেখা দিয়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাবও পড়েছে বস্ত্রশিল্প খাতে।
দেশে রাসায়িক পণ্যের অনেক শিল্পখারখানা গড়ে উঠেছে। এগুলো থেকে উৎপাদিত পণ্য দেশের চাহিদার একটি অংশ মেটানোর পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানি করে। এ খাতের কাঁচামালের এলসি কমেছে ৪৮ দশমিক ২৩ শতাংশ। আমদানি কমেছে সাড়ে ৫২ শতাংশ।
নির্মাণ খাতের সিমেন্ট উৎপাদনের কাঁচামাল ক্লিংকার ও পাথর আমদানির এলসি কমেছে ৪৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ। আমদানি কমেছে ৪১ দশমিক ৪৯ শতাংশ। একই সঙ্গে বিপি শিট আমদানির এলসি বেড়েছে ২২ দশমিক ৫২ শতাংশ, আমদানি বেড়েছে ২২ দশমিক ০৭ শতাংশ। তবে এর দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়ায় পরিমাণে কম পণ্য আমদানি হচ্ছে। এছাড়া এর মাধ্যমে দেশ থেকে টাকা পাচারের আশঙ্কাও করা হচ্ছে।
চালু শিল্পের পাশাপাশি নতুন শিল্প স্থাপনেও মন্দা দেখা দিয়েছে। বৈশ্বিক মন্দা ও ডলার সংকটের কারণে উদ্যোক্তা হাত গুটিয়ে বসে আছেন। তারা নতুন বিনিয়োগে হাত দিচ্ছেন না বলেই চলে। এতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কমে গেছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে এ খাতে ঋণ প্রবাহ বেড়েছে মাত্র সোয়া ১ শতাংশ। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম।
গত অর্থবছরের একই সময়ে ঋণ প্রবাহ বেড়েছিল ২ শতাংশের বেশি। গত অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে এ খাতে ঋণ বেড়েছিল ১১ হাজার কোটি টাকার বেশি। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছে মাত্র এক হাজার কোটি টাকার কম। তবে ডলারের হিসাবে ঋণ প্রবাহ আরও কম বেড়েছে। কারণ ডলারের দাম বাড়ায় এ খাতে ঋণ প্রবাহ কমে গেছে। বেসরকারি খাতের ঋণের একটি বড় অংশই আমদানিতে ব্যবহৃত হয়। যে কারণে এ ঋণের সঙ্গে ডলারের যোগসূত্র রয়েছে।
গত অর্থবছরেও শিল্পের যন্ত্রপাতির আমদানি কমেছিল। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৩ মাসেও শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি এলসি কমেছে ২৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ, আমদানি কমেছে ৩৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। ফলে নতুন শিল্প স্থাপনে নেতিবাচক পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে বস্ত্র খাতের যন্ত্রপাতির এলসি ৫১ শতাংশ, আমদানি কমেছে ৬৪ শতাংশ।
চামড়া খাতের যন্ত্রপাতির এলসি ৮১ শতাংশ, আমদানি কমেছে সাড়ে ৮৫ শতাংশ। পাট খাতের যন্ত্রপাতির এলসি কমেছে সাড়ে ৪১ শতাংশ, আমদানি কমেছে সাড়ে ৬৭ শতাংশ। গার্মেন্ট খাতের এলসি ১৭ শতাংশ, আমদানি কমেছে সাড়ে ৩১ শতাংশ। ওষুধ শিল্পের ৬৭ শতাংশ এলসি ও আমদানি কমেছে সোয়া ৭৪ শতাংশ। প্যাকিং খাতের এলসি সাড়ে ৭৫ শতাংশ ও আমদানি কমেছে সাড়ে ৪৪ শতাংশ। অন্যান্য খাতের শিল্পের যন্ত্রপাতির এলসি কমেছে সোয়া ২০ শতাংশ, আমদানি কমেছে সাড়ে ৪১ শতাংশ। বিবিধ শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি এলসি ১১ শতাংশ ও আমদানি কমেছে ৩৬ শতাংশ।
শিল্পের পাশাপাশি ভোগ্যপণ্যের আমদানিও কমেছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে ভোগ্যপণ্যের এলসি কমেছে ৪৮ শতাংশ ও আমদানি কমেছে ১৬ শতাংশ।
সূত্র: যুগান্তর