ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা, যা ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক জীবনকে একটি সুসমন্বিত কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসে। ইসলামী শিক্ষার মূল ভিত্তি হল আল্লাহর প্রতি অনুগত্য, মানবতার কল্যাণ, নৈতিক মূল্যবোধ এবং সামাজিক শৃঙ্খলা। কিন্তু আধুনিক বিশ্বের প্রেক্ষাপটে বিজ্ঞানের অগ্রগতি, প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশ এবং নতুন নতুন জীবনধারা ইসলামের ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধের সঙ্গে এক ধরনের দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করছে। ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার-আচরণের পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তিগত উন্নয়ন কীভাবে ইসলামের অনুশীলনে প্রভাব ফেলছে, তা নিয়ে বর্তমান সময়ে একাধিক প্রশ্ন উঠে এসেছে।
আধুনিক প্রযুক্তির বিকাশ ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং সমাজের মৌলিক ভিত্তির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে বলে অনেক ইসলামী চিন্তাবিদ মনে করেন। যেমন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যাপক ব্যবহারের ফলে সামাজিক সম্পর্কের অবনতি, ব্যক্তি জীবনের একান্ত মুহূর্তের প্রকাশ্যতা, এবং গোপনীয়তার লঙ্ঘন নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। ইসলামে পবিত্রতা, শালীনতা ও গোপনীয়তার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কুরআন এবং হাদিসে বিভিন্ন আয়াতে মানব সমাজের নৈতিকতা রক্ষা ও গোপনীয়তা বজায় রাখার কথা বলা হয়েছে। তবে আজকের প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এমন এক বাস্তবতা তৈরি করেছে যেখানে ব্যক্তিগত তথ্য ও ছবি সহজেই অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ে এবং এগুলো সমাজে অনৈতিকতার বিস্তারে ভূমিকা রাখতে পারে।
আধুনিক অর্থনীতি এবং প্রযুক্তি ইসলামী অর্থনীতির মূলনীতিগুলির সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ, এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। ইসলামী অর্থনীতি মূলত সুদমুক্ত এবং সমতাভিত্তিক ব্যবস্থার ওপর প্রতিষ্ঠিত, যেখানে ধন-সম্পদের সুষম বণ্টন এবং জাকাতের মাধ্যমে দরিদ্রদের অধিকার রক্ষার ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আজকের প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বব্যবস্থায় যে অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে উঠেছে, তা অনেক ক্ষেত্রেই সুদ-ভিত্তিক এবং অসামঞ্জস্যপূর্ণ বিত্ত বৈষম্য তৈরি করছে। অনলাইন ব্যাংকিং, ক্রিপ্টোকারেন্সি, এবং নতুন ধরনের ফিনটেক উদ্ভাবনগুলো ইসলামের সুদবিরোধী নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা তা নিয়ে অনেক আলেম ও অর্থনীতিবিদ দ্বিধায় রয়েছেন।
আধুনিক চিকিৎসা এবং জীববিজ্ঞানেও ইসলামের মূল্যবোধের চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে। ইসলামে জীবনের প্রতি সম্মান এবং প্রাণহানির কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবে আধুনিক জৈবপ্রযুক্তি এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতি—যেমন ক্লোনিং, স্টেম সেল গবেষণা, বা মানব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন—মৃত্যুর প্রাকৃতিক সীমা নিয়ে নতুন প্রশ্ন তুলেছে। ইসলামী আইনে, এ ধরনের প্রযুক্তির ব্যবহারে ধর্মীয় নীতির সংরক্ষণ অত্যাবশ্যক। উদাহরণস্বরূপ, ক্লোনিং এবং জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে মানব জীবনের প্রাকৃতিক ধারাকে পরিবর্তন করা ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত বিতর্কিত এবং অনেক ক্ষেত্রেই অনৈতিক বলে বিবেচিত হয়।
তবে ইসলামের মৌলিক মূল্যবোধ এবং আধুনিক প্রযুক্তির মধ্যে একটি ইতিবাচক সংমিশ্রণও বিদ্যমান। যেমন, ধর্মীয় অনুশীলনে প্রযুক্তি ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে। উদাহরণস্বরূপ, পবিত্র কোরআন এবং হাদিসের অনুবাদ এবং ব্যাখ্যার সফটওয়্যার, মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন এবং অনলাইন শিক্ষার প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ইসলামী শিক্ষা ও জ্ঞান অধিক মানুষের কাছে সহজলভ্য হয়েছে। হজ এবং উমরাহ পালনকারীদের জন্য আধুনিক প্রযুক্তি, যেমন ন্যাভিগেশন সিস্টেম এবং বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করে সহজ ও নিরাপদ ভ্রমণ সম্ভব হয়েছে। অনলাইনে দান এবং জাকাত প্রদানও এখন প্রযুক্তির কল্যাণে অনেক সহজ হয়েছে, যা সমাজের দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিতদের দ্রুত সহায়তা প্রদান করে।
অপরদিকে, ইসলামের ভিত্তি হল কুরআন এবং হাদিসে প্রদত্ত জ্ঞান, যা কালজয়ী এবং সর্বকালের জন্য প্রযোজ্য। ইসলামী আইন (শরিয়া) একটি পরিবর্তনশীল সমাজের সাথে সামঞ্জস্য রাখতে সক্ষম। কিন্তু প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতি এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, যেখানে শরিয়া বিশেষজ্ঞদের নিরন্তর নতুন নতুন সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বায়োইঞ্জিনিয়ারিং, এবং সামাজিক মিডিয়ার ব্যাপক বিস্তারে নতুন ধরনের আইন প্রণয়ন প্রয়োজন, যা ইসলামী মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। বিভিন্ন ফিকহ বোর্ড এবং ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞরা এইসব বিষয়ে ফতোয়া প্রদান করে থাকেন, কিন্তু এক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান এবং ইসলামী জ্ঞানের সংমিশ্রণ অপরিহার্য।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশ একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ, যেখানে ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং আধুনিক জীবনধারার মধ্যে একটি মেলবন্ধনের প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশে প্রযুক্তির দ্রুত প্রসার, বিশেষ করে মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেটের ব্যবহার, ইসলামের মূল্যবোধের সঙ্গে বেশ কয়েকটি নতুন সামাজিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। তরুণ সমাজের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতি আসক্তি, অনলাইন গেমিং এবং ভার্চুয়াল বাস্তবতা নিয়ে ব্যস্ততা অনেক সময় ইসলামী আচার-আচরণের পরিপন্থী হতে পারে। তবে বাংলাদেশের আলেম এবং শিক্ষাবিদরা এই প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে ইসলামের শিক্ষা এবং মূল্যবোধকে রক্ষা করার জন্য কাজ করছেন।
পরিশেষে বলা যায়, আধুনিক বিশ্বে ইসলামের মুখোমুখি হওয়া প্রযুক্তিগত এবং সামাজিক চ্যালেঞ্জগুলোকে অস্বীকার করা যায় না। তবে ইসলাম এমন একটি ধর্ম যা সর্বদা পরিবর্তনশীল সমাজের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে। বর্তমান প্রযুক্তির উন্নয়নকে ইসলামিক নীতি এবং মূল্যবোধের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে ইসলামী চিন্তাবিদ, আলেম, এবং সমাজের সকল স্তরের মানুষের যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে একটি ভারসাম্যপূর্ণ পথ বের করতে হবে, যা প্রযুক্তির সুবিধাগুলো গ্রহণ করে এবং একই সাথে ধর্মীয় মূল্যবোধকে অটুট রাখে। আল্লাহর বাণী অনুযায়ী, “তোমরা জ্ঞান অর্জন করো, কারণ জ্ঞান আল্লাহর এক বিশেষ অনুগ্রহ” (হাদিস)। অতএব, প্রযুক্তিগত অগ্রগতিকে সঠিকভাবে পরিচালনা করে ইসলামের মূলনীতি অনুযায়ী জীবন গড়ে তোলা আমাদের দায়িত্ব।
সহযোগী অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ
হাবীবুল্লাহ্ বাহার কলেজ, ঢাকা।