সম্পাদকীয় ডেস্ক, আজনিউজ২৪: আজ ১ মার্চ। স্বাধীন স্বার্বভৌম বাংলাদেশ তার ৫০ বছরের অগ্নিঝরা মার্চে পা দিলো লাল সবুজের পতাকা। তাই ১৯৭১ সালের ইতিহাসের ১ মার্চকে আজ মনে করার পবিত্র দিন। এই দিনটিতে খুব দুঃখজনকভাবে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আগা মুহাম্মদ ইয়াহিয়া খান ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি সাসপেন্ড করে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে তখন আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন হয়ে গেছে। সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান নতুন বাংলাদেশ গঠনের জন্য প্রস্তুত। সব কিছু জেনেও জেনারেল আগা মুহাম্মদ ইয়াহিয়া খান সংসদ সাসপেন্ড করে দিলেন, যাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতাসীন হতে না পারেন। এক সপ্তাহের মধ্যেই ৭ই মার্চ শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হলো। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতারা বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দিলেন। রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবের সেই ঐতিহাসিক ভাষণে প্রথম শোনা গেল জয় বাংলার স্লোগান। তিনি বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ আজ গণতন্ত্রকে হত্যার সেই চেষ্টার কথা মনে করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে এটাও আমাদের মনে পড়ে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলন এর ফলে আরো জ্বালাময়ী হয়ে উঠল।
এর আগের মাসটিতে ভাষা দিবস এবং বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন নিয়ে ভালো আলোচনা শুনছিলাম সম্প্রীতি বাংলাদেশের মঞ্চে। পরদিন ছিল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের পাক্কালে আলোচনায় উঠে এলো, মাতৃভাষার সঙ্গে একটি দেশের স্বাধীনতা ও রাষ্ট্র গঠন কিভাবে সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশে। আলোচনাটা শুনতে শুনতে আমি ভাবছিলাম, পৃথিবীর আর অন্য কোনো রাষ্ট্র সম্ভবত নেই, যারা ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাদের জাতিসত্তার পরিচয় প্রতিষ্ঠিত করেছে। যেমনটি জাতিরজনক বঙ্গবন্ধুর আত্মত্যাগ আছে, আবার একটা ভাষার আইডেনটিটি, ধর্মীয় আইডেনটিটিকে পাশে রেখে এগোতে পেরেছে। গোটা পৃথিবীর সঙ্গে যুক্ত করে সামনের দিকে এগোনোর চেষ্টা দীর্ঘদিন ধরে করে চলেছেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের উপযুক্ত কন্যা, দেশরত্ন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেটার জন্য আজ বাংলাদেশের এই আর্থিক অগ্রগতি। আয়তনে বাংলাদেশ ছোট হওয়া সত্ত্বেও ইতোমধ্যে সারাবিশ্বের কাছে আর্থিক বৃদ্ধির হার নজর কেড়েছে। বিশ্বব্যাংক থেকে শুরু করে অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংগঠন ও সংস্থা ভালো রিপোর্ট দিচ্ছে। বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র বিপন্ন হচ্ছে, চারদিকে সামরিক অভ্যুত্থান হচ্ছে; শুধু তো পাকিস্তান নয়, মিয়ানমারে সামরিক শাসন হয়ে গেল। শ্রীলঙ্কায় যখন নানা রকমের রাজনৈতিক টালমাটাল চলছে এবং নেপালে যখন অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে, তখন বাংলাদেশ এত বাধা-বিপত্তির মধ্যেও শুধু যে এগোচ্ছে তা-ই নয়; শুধু রাজনীতির প্রেক্ষাপটে নয়, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক মঞ্চ থেকেও চেষ্টা চলছে বাংলা ভাষাকে আরো ছড়িয়ে দেওয়ার এবং নানা রকমের কর্মসূচি গ্রহণ করার।
১৯৭১ সালের মুক্তি আন্দোলন, স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন, সবশেষে মায়েরভাষা বাংলাকে গোটা পৃথিবীতে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাস সক্রিয় হয়ে উঠেছে। মাতৃভাষা বাংলাকে শুধু সাহিত্যে নয়, চলচ্চিত্র ও বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। বাংলাদেশের মানুষ পৃথিবীজুড়ে রয়েছে। বাঙালি রয়েছে আরো অনেক। সব মিলিয়ে যদি বাংলা ভাষাকে নিয়ে একটি মঞ্চ থেকে, একটি প্ল্যাটফর্ম থেকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, তাহলে হয়তো একাত্তরের যে সাধনা, সেই সাধনা শুধু একটি স্মৃতিচর্চা বা অতীতাসক্তিতে না থেকে আগামী দিনে আর্থ-সামাজিকভাবে উন্নয়নশীল পাশ্ববর্তী দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক অর্থনৈতিক অগ্রগতি হবে। এই উপমহাদেশের আর্থিক অগ্রগতির একটি রোডম্যাপ তৈরি করা সম্ভব হবে। সেটাই হবে আজকের দিনের সবচেয়ে বড় কর্তব্য। সেখানে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম হবে চলার পাথেয়।
মার্চ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মাস। ১৯৭১ সালের ১ মার্চও ছিল সোমবার। আর এ দিনটা এই জন্য ভয়ানক স্মৃতি। ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জিতেছে। তাদের ক্ষমতায় আসার কথা। তা সত্ত্বেও ১ মার্চ পার্লামেন্ট মুলতবি করে দেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। তারপর গোটা পরিস্থিতি আরো উত্তাল হয়ে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু নয়; ৯ মার্চ চট্টগ্রাম বন্দরে কোনো রকমভাবে জাহাজে জিনিস না তোলার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন আন্দোলনকারীরা। ১০ মার্চ জাতিসংঘের সামনে বাঙালিরা প্রতিবাদ বিক্ষোভে মুখর হয়ে ওঠে। ২৬শে মার্চ একটি ভয়াবহ আন্দোলন শুরু হয়। ২৫শে মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে সেনাবাহিনীর অপারেশন সার্চলাইট শুরু হয়। আর ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে সেনা অভিযান শুরু হওয়ার পরপরই ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার আগে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তারপর এক লম্বা ইতিহাস।
স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও আমরা জাতিগত জীবনে যা অর্জন করতে পারিনি, জাতি হিসেবে আমাদের যদি কোন কিছু পেছনে পড়ে থাকে, তার উত্তরণ ঘটিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শকে সমাজে, রাষ্ট্রে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য এই সুবর্ণজয়ন্তীতে নতুন করে শপথ নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে এবারের অগ্নিঝরা মার্চ।