ঋতু বৈচিত্র্যে ভরপুর এই বাংলাদেশে দুই মাস পরপর পাল্টে যায় প্রকৃতি। সেই সুবাদে নয়ারূপে আবির্ভূত হয় নিসর্গ। অন্তরীক্ষ থেকে মৃত্তিকার বুকে ধরা দেয় পরিবর্তনের ছোঁয়া। ঋতুচক্রের সেই বদলে যাওয়া প্রেক্ষাপটে প্রভাবিত হয় যাপিত জীবন। আর বাঙালির মন-প্রাণকে আলোড়িত করা তেমনই এক ঋতু বর্ষাকাল। আজ রবিবার সেই রূপময় ঋতুর প্রথম দিন পয়লা আষাঢ়। প্রচ- তাপপ্রবাহকে বিদায় জানিয়ে বৃষ্টির জলে সিক্ত হবে প্রকৃতি ও প্রাণ। পুষ্প-বৃক্ষ, পত্রপল্লবে সঞ্চারিত হবে নতুন প্রাণ। চারপাশে চোখে পড়বে সবুজের সমারোহ।
Ezoic
তাই তো কাব্যিক উচ্চারণে বলতে হয়- আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে/আসে বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে/এই পুরাতন হৃদয় আমার আজি পুলকে দুলিয়া উঠিছে আবার আজি…। এভাবেই বাঙালির মননে ভালোলাগার অনুভব ছড়িয়ে দেয় বর্ষারানী। অসহনীয় গরমকে হটিয়ে জাগিয়ে তোলে শীতল অনুভূতি। আবহমানকাল ধরেই বাঙালির মন উতল করা প্রিয় ঋতু বর্ষাকাল। আষাঢ় ও শ্রাবণ মাসকে যুক্ত করা এই বর্ষায় প্রকৃতির শোভাময়তার সমান্তরালে আকাশে ভাসমান মেঘের ভেলায় উচাটন হয় মন-প্রাণ। সুন্দরতম দৃশ্যকল্পে মুগ্ধতার আবেশে চঞ্চল হয় নয়ন।
দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ, মেঘলা আকাশ, টলমলে জলের পুকুর, সোঁদা মাটির গন্ধ কিংবা বৃষ্টিভেজা সবুজ ঘাসÑসবকিছুতেই বিরাজ করে মায়াবী আবহ। রূপের বিভায় কিংবা সুবাসে কাছে টানে বর্ষায় ফোটা শাপলা, জুঁই, মকামিনী, মালতি, ঝুমকোলতা পদ্ম, কদম, কেয়াসহ বাহারি গড়নের রকমারি ফুল। শহরের চাইতে গ্রামবাংলায় বর্ষা রূপটি অনেক বেশি বিস্তৃত। বৃষ্টিঝরা থইথই জলে শোল, বোয়াল, কই, শিংসহ নানা প্রজাতির মাছের দেখা মেলে। আসমান কাঁপানো গুড়–ম গুড়–ম ডাকে সাগর-নদী থেকে এসব মাছ খাল, বিল, পুকুর ও জলাশয়ে উঠে আসে।
বাংলা সনের তৃতীয় মাস আষাঢ়। আর এই নামটি এসেছে পূর্বাষাঢ়া নক্ষত্রে সূর্যের অবস্থান থেকে। বর্ষায় গ্রীষ্মের ধুলোমলিন জীর্ণতাকে ধুয়ে-মুছে প্রকৃতি সেজে ওঠে পূর্ণতায়। গ্রীষ্মের তাপপ্রবাহে মানুষ যখন পুড়ে অঙ্গার তখন বর্ষার রিমঝিম বৃষ্টির বরণডালায় সিক্ত হয় শরীর। বর্ষাকালে অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরার নেপথ্যে রয়েছে আবহাওয়াগত পরিবর্তন। সেটি হচ্ছে এই সময় জলীয়বাষ্পবাহী দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। বছরের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয় বর্ষায়। নিয়মিত বর্ষণে বদলে যায় চারপাশের পরিবেশ।
Ezoic
পরিবর্তিত এ রূপের বর্ণনায় প্রয়াত প্রকৃতিবিদ দ্বিজেন শর্মা বলেছেন, বর্ষার ভারি বর্ষণে শরীর ধুয়ে নেয় প্রকৃতি। পরিচ্ছন্ন হয়। নতুন করে জেগে ওঠে। বেলী, বকুল, জুঁই, দোলনচাঁপা, গন্ধরাজ, হাসনাহেনার ঘ্রাণে ভরে ওঠে চারপাশ। আর মিষ্টি হাসি হয়ে ফোটে ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’। সব মিলিয়ে বলা যায় বাঙালি জীবনের এক নতুন আবাহন বর্ষাকাল। রোদ-বৃষ্টির খেলায় আনন্দের বন্যা বয়ে যায় বাঙালির মনে। উল্টোদিকে আবার কিছু কিছু অঞ্চলে দেখা যায় প্রচ- খরায় অতিষ্ঠ হয়ে মানুষ কুলা ও থালাবাটি নিয়ে উঠানে বসে গাইতে থাকে ‘আল্লাহ মেঘ দে পানি দে ছায়া দেরে তুই আল্লাহ মেঘ দে’।
আপন রূপ-রসে বাংলা সাহিত্য ও শিল্প ভুবনকে তুমুলভাবে প্রভাবিত করেছে বর্ষাঋতু। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায়Ñ এসেছে বরষা, এসেছে নবীনা বরষা,/গগন ভরিয়া এসেছে ভুবন ভরসা …। জাতীয় কবি নজরুল লিখেছেন- রিমঝিম রিমঝিম ঝিম ঘন দেয়া বরষে/কাজরি নাচিয়া চল, পুর-নারী হরষে …। ভাটি বাংলার বাউলসাধক উকিল মুন্সি লিখেছেন- যেদিন হইতে নয়া পানি আইলো বাড়ির ঘাটে সখি রে/অভাগিনীর মনে কত শত কথা ওঠে রে…। বর্ষার মহিমায় বিশ্বকবি লিখেছেন- মন মোর মেঘের সঙ্গী/উড়ে চলে দিগ্ দিগন্তের পানে/নিঃসীম শূন্যে শ্রাবণবর্ষণ সঙ্গীতে/রিমিঝিম রিমিঝিম রিমিঝিম…।
নয় বছরের আমানের বিশ্বরেকর্ড
আরেক লোককবি দুর্বিন শাহ সুরবাণীতে উচ্চারিত হয়- প্রাণ সখিরে, আষাঢ় মাসে নতুন জোয়ার, ডুবায় গাঙ্গের দুটি পাড় খেলব সাঁতার কারে সঙ্গে লইয়া…। মনে করিয়ে দেয় নজরুলের সেই বিরহী সুরবাণীÑ শাওন আসিল ফিরে সে ফিরে এলো না/বরষা ফুরায়ে গেল আশা তবু গেল না …। অভিন্ন অনুভবে উকিল মুন্সি বলেছেনÑ আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি রে/পুবালী বাতাসে/বাদাম দেইখ্যা, চাইয়া থাকি/আমারনি কেউ আসে রে …। বর্ষায় আমূল বদলে যায় বাংলার হাওড় অঞ্চল। গ্রীষ্মে হাওড়ের হাঁটা পথে অথৈ জল নেমে আসে বর্ষায়। শুকনো মৌসুমে যে জায়গায় হালচাষ করে কৃষক ভরা বর্ষায় সেখানে জাল ফেলে মাছ ধরে জেলে।এ কারণে সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা-এই সাত জেলার লোককবিরা বর্ষা দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। বর্ষার সৌন্দর্যের উল্টোপিঠে স্মরণ করিয়ে দিতে ভোগান্তির কথাটিও। অনেক সময় অতি বৃষ্টিতে বিভিন্ন অঞ্চল বন্যা আক্রান্ত হয়। এ সময় রাস্তায় পানির নিচে লুকিয়ে থাকা গর্তে পড়ে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকে। পানি নিষ্কাশনের দুর্বল ব্যবস্থার কারণে সড়কে বাড়ে জনদুর্ভোগ। পলিথিনের অপব্যবহার এবং যত্রতত্র আবর্জনা ফেলায় এ অবস্থা আরও প্রকট হয়।
পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা দুর্বল থাকায় পানি নামতে দেরি হয়। বিভিন্ন অপরিশোধ্য বর্জ্য নালা ও নর্দমায় জমে আটকে থাকে। ফলে পানি নামতে পারে না। এসব সংকটের সমাধান করে উপভোগ করতে হবে বর্ষাকাল। বর্ষণের দুর্ভোগ থেকে রক্ষা পেতে নিতে হবে পরিকল্পিত পদক্ষেপ।
রাজধানীতে বর্ষা বন্দনা : আজ রবিবার রূপময় ঋতু বর্ষা উদ্যাপনে সরব হয়ে উঠবে রাজধানীর সংস্কৃতি অঙ্গন। এদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় বর্ষা উৎসব-১৪৩২-এর আয়োজন করেছে বর্ষা উৎসব উদ্যাপন পরিষদ। আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে সকাল সোয়া সাতটায় সেতারের সুরে এ উৎসবের সূচনা করবেন শিল্পী সোহানী মজমুদার।