গত সোমবার বেলা দেড়টা। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) সামনে অপেক্ষা করছেন হাবিবুর রহমান। গতকাল তাঁর সন্তান জারিফ ফারহান স্কুল থেকে বাড়ি না ফিরে ভর্তি হয়েছে হাসপাতালে। জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে শিশুটির আইসিইউ বেড নম্বর ১৬। ফারহানের বয়স ১৪। সে উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলে পড়ে। তার দেহের ৩৮ শতাংশ পুড়ে গেছে।
অপেক্ষারত হাবিবুর রহমানকে সান্ত্বনা দেওয়ার কোনো ভাষা ছিল না। তাঁর কাঁধে এই প্রতিবেদক হাত রাখতেই কিছুটা ক্ষোভের সঙ্গে তিনি বলতে থাকেন, ‘ভাই, আপনারা কী দেশ বানালেন? সন্তানের সব থেকে নিরাপদ জায়গা হচ্ছে তাঁর বিদ্যালয়। সেখানে কেমন করে আমার সন্তানের দেহ ঝলসে গেল? জেট ফুয়েলের লেলিহান শিখা…ভাই, আমার কিছু বলার নেই। আমি আইসিইউয়ের সামনে আমার সন্তানের লাশের জন্য অপেক্ষা করছি…।’ গত রোববার উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ওপর বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়। সেই দুর্ঘটনায় আহত হয় ফারহান।
জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের অপরিচ্ছন্ন গুমোট লিফট বেয়ে উঠতে উঠতে ঘটনার ভয়াবহতা বর্ণনা করছিলেন তিন বন্ধু শহিদুল ইসলাম, জাকির হোসেন ও আজিজুল হক। তাঁরা বলছিলেন, জেট ফুয়েলের আগুন কী রকম ভয়াবহ হতে পারে, এ সম্পর্কে আপনাদের কোনো ধারণা নেই। মুহূর্তেই সবকিছু ঝলসে যায়।
তিন বন্ধুর সঙ্গে বার্ন ইনস্টিটিউটের ১৪ তলায় নেমে নামাজঘরের সামনে কথা হয়। তাঁরা জানান, তাঁরা আসলে চার বন্ধু শহীদুল, জাকির, আজিজুল ও মিনহাজুর। গ্লাস অ্যান্ড সিরামিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী থাকার সময় থেকেই তাঁরা হরিহর আত্মা। একজনের সুখে–দুঃখে অন্যরা গিয়ে দাঁড়ান। আজ মিনহাজুরের দুর্দিন। তাঁর ছেলে মাহতাবুর রহমান জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে সংগ্রাম করছে।
তিন বন্ধুর সহায়তায় কথা হয় মিনহাজুরের সঙ্গে। গ্রেট ওয়াল সিরামিকসের সহকারী মহাব্যবস্থাপক মিনহাজুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, ‘আমার একমাত্র ছেলে। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ত। বিনয়ী-মেধাবী। সপ্তম শ্রেণিতে তার রোল নম্বর ছিল ১। কী থেকে কী হয়ে গেল।’ কান্নাজড়ানো কণ্ঠে তিনি তাঁর সন্তানের জন্য দোয়া চাইলেন।
ভয়াবহ সেই আগুনের বর্ণনা দিচ্ছিলেন সালেহা বেগম। তিনি বলেন, ‘স্কুলের ছুটির ঘণ্টা বেজেছে। আমি ছেলের জন্য অপেক্ষা করছি। হঠাৎ বিকট শব্দে বিমানটা দ্রুতগতিতে বিল্ডিংয়ে আঘাত করল। আগুনের গনগনে লাল শিখা। মুহূর্তেই সবকিছু জ্বলেপুড়ে গেল।’
সালেহা বেগমের দুই ছেলে। বড় ছেলে কলেজে পড়ে। ছোট ছেলে আবদুল মোছাব্বির মাকিন। বয়স ১৩। মাইলস্টোন স্কুলের (বাংলা মিডিয়াম) সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী সে। আগুনে ১৩ বছরের শিশু মাকিনের শরীরের ৬৮ শতাংশ পুড়ে গেছে। জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে ভর্তি মাকিনের বেড নম্বর ১৮।
আমাদের মাকিনরা ফুল হয়ে ফুটবার আগেই ঝরে পড়ে। আমরা কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি, আমাদের মাকিনরা আঠারো ছুঁতে পারবে।