‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করে ৫ আগস্ট সারা দেশের ছাত্র-জনতাকে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করার আহ্বান জানিয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সেদিন ছিল সোমবার, ‘শেখ হাসিনা সরকারের পতন ও ফ্যাসিবাদের বিলোপের’ এক দফা দাবিতে অসহযোগ আন্দোলনের দ্বিতীয় দিন। বিপুল জনস্রোতের লক্ষ্য ছিল গণভবন।
সেদিন সকালেও ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ হয়। সেদিন ঢাকার সব প্রধান সড়কেই নেমে আসেন লাখ লাখ মানুষ। উত্তরা, যাত্রাবাড়ী, পুরান ঢাকা, শাহবাগসহ বিভিন্ন দিক থেকে আসছিলেন ছাত্র–জনতা। বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিক্ষোভকারীদের আটকে দেওয়ার চেষ্টা করে। সেনাবাহিনীর সদস্যদেরও কিছু স্থানে অবস্থান নিতে দেখা যায়। একপর্যায়ে সেনাবাহিনীর সদস্যরা ছাত্র–জনতার মিছিলের বাধা সরিয়ে নেন। দুপুরের আগেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে সরকার নড়বড়ে হয়ে গেছে।
ছাত্র–জনতার সবার গন্তব্য ছিল গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও জাতীয় সংসদ ভবন। একপর্যায়ে তাঁরা গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও সংসদ ভবনের মধ্যে ঢুকে পড়েন।
জনস্রোত গণভবনে পৌঁছানোর আগেই ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে বেলা আড়াইটায় একটি সামরিক হেলিকপ্টারে করে ভারতে পালিয়ে যান স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা, যিনি কয়েক দিন আগেই (১ আগস্ট) বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনা কখনো পালায় না।’
গণভবনের মাঠে হাত উঁচু করে উল্লাস করেন অনেকে। কেউ কেউ গণভবন ও সংসদে ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিস নিয়ে বেরিয়ে যান। সংসদ ভবনে প্রবেশ করেও উল্লাস ও আনন্দ মিছিল করেন ছাত্র–জনতা। অনেকের হাতে ছিল লাল–সবুজের জাতীয় পতাকা। বিকেল থেকে ছাত্র–জনতা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গিয়ে অবস্থান নেন। অনেকেই কার্যালয়ের ছাদে উঠে যান।
ছাত্র–জনতার অনেকে নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশ করেন গণভবন-প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও সংসদের দেয়াল এবং বিভিন্ন স্থাপনায় লিখে, ছবি এঁকে। দেয়ালে বিভিন্ন প্রতিবাদী লিখনে উঠে আসে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার শাসনামলের নানা অনিয়ম ও দুঃশাসনের কথা।
জনস্রোত গণভবনে পৌঁছানোর আগেই ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে বেলা আড়াইটায় একটি সামরিক হেলিকপ্টারে করে ভারতে পালিয়ে যান স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা, যিনি কয়েক দিন আগেই (১ আগস্ট) বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনা কখনো পালায় না।’
সেনাপ্রধান বলেন, সব হত্যাকাণ্ড ও অন্যায়ের বিচার করা হবে। এ জন্য সেনাবাহিনী ও সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি আস্থা রাখার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি সমস্ত দায়দায়িত্ব নিচ্ছি। আপনাদের জানমাল…এবং আপনাদের আমি কথা দিচ্ছি যে আপনারা আশাহত হবেন না।’
এর মধ্য দিয়ে ছাত্র-জনতার জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সফল পরিণতি ঘটে। সব মিলিয়ে ১৪ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট, ছাত্র–জনতা শেখ হাসিনার মুখোমুখি অবস্থান নেওয়ার পর বাংলাদেশের মানুষ মুক্তি পেলেন চরম কর্তৃত্ববাদী এক শাসন থেকে। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার দিন সকালেও গুলি চলে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায়, যাতে ছাত্র-জনতার অনেকে হতাহত হন। পালিয়ে যাওয়ার পরও এমন গুলির ঘটনা ঘটে। এ দিন সারা দেশে শতাধিক মানুষ নিহত হন। তার আগের দিনও নিহত হন শতাধিক।
সরকার পতনের পর মানুষের দীর্ঘদিনের পূঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে সারা দেশে। প্রধান বিচারপতির বাসভবন, আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত বাসভবন সুধা সদনসহ রাজধানীতে বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে সদ্য বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, দলীয় সংসদ সদস্য ও নেতাদের বাসভবন ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও হামলার ঘটনা ঘটে। হামলা ও আগুন দেওয়া হয় আওয়ামী লীগের কার্যালয়েও।
সেনাপ্রধানের ভাষণ, সমন্বয়কদের সংবাদ সম্মেলন
শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর সেনা সদর দপ্তরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক করেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। বৈঠকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল (বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা) ছাড়াও রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে ছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ, ইসলামী আন্দোলনের নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের, কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ (পরে অব্যাহতি পাওয়া) ও মহাসচিব মুজিবুল হক (পরে অব্যাহতি পাওয়া), বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব (বর্তমানে আমির) মাওলানা মামুনুল হক এবং গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি।
ওই বৈঠকের পর সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জনগণের উদ্দেশে বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, ‘সমস্ত প্রধান প্রধান দলের নেতারা এখানে উপস্থিত ছিলেন। আমি তাঁদের এখানে ইনভাইট করেছিলাম। আমরা একটা সুন্দর আলোচনা করেছি। আমরা একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দেশের সব কার্যক্রম এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দ্বারা পরিচালিত হবে।’
সেনাপ্রধান বলেন, সব হত্যাকাণ্ড ও অন্যায়ের বিচার করা হবে। এ জন্য সেনাবাহিনী ও সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি আস্থা রাখার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি সমস্ত দায়দায়িত্ব নিচ্ছি। আপনাদের জানমাল…এবং আপনাদের আমি কথা দিচ্ছি যে আপনারা আশাহত হবেন না।’
একই সঙ্গে সহিংসতার পথ ছেড়ে সবাইকে শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যার সমাধান ও ঘরে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানান সেনাপ্রধান। তিনি অতি শিগগির ছাত্র-শিক্ষক প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন বলেও জানান।
সেদিন বিকেলে বঙ্গভবনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। বৈঠকে আন্দোলনে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে শোক প্রস্তাব গৃহীত হয়। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সবাইকে ধৈর্য ও সহনশীল আচরণ করার আহ্বান জানানো হয়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যেন কোনোভাবেই বিনষ্ট না হয়, সে ব্যাপারে বৈঠকে একমত পোষণ করা হয়।
বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়া হবে। এ ছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে এবং সম্প্রতি বিভিন্ন মামলায় আটক সব বন্দীকে মুক্তি দেওয়ারও সিদ্ধান্ত হয়।
সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন ও নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম নাজমুল হাসান এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে বঙ্গভবনে সেই বৈঠকে ছিলেন বিএনপির মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও মির্জা আব্বাস, জামায়াতে ইসলামীর শফিকুর রহমান ও এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ, জাতীয় পার্টির জি এম কাদের, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও মুজিবুল হক, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক, খেলাফত মজলিসের মামুনুল হক, ইসলামী আন্দোলনের সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম ও আশরাফ আলী আকন, গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের হাসনাত কাইয়ূম, জেএসডির শহীদ উদ্দিন মাহমুদ, ভাসানী অনুসারী পরিষদের শেখ রফিকুল ইসলাম, মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে রাব্বী প্রমুখ।
অন্যদিকে ৫ আগস্ট রাতে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। এ সময় সমন্বয়ক সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ, আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া ও আবু বাকের মজুমদার তাঁর সঙ্গে ছিলেন। সারজিস ও হাসনাত এখন জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা, আসিফ মাহমুদ অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আর আবু বাকের গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের আহ্বায়ক।
সেই সংবাদ সম্মেলনে নাহিদ ইসলাম বলেন, অভ্যুত্থানকারী ছাত্র-নাগরিকের সমর্থিত বা প্রস্তাবিত সরকার ছাড়া আর কোনো ধরনের সরকারকে সমর্থন করবে না বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সেনাসমর্থিত সরকার বা জরুরি অবস্থা দিয়ে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার—এ ধরনের কোনো সরকারকে বিপ্লবী ছাত্র-জনতা গ্রহণ করবেন না।
পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাঁরা একটি অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকারের প্রস্তাব করবেন উল্লেখ করে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘এই সরকার হবে অভ্যুত্থানকারী ছাত্র-নাগরিকের প্রস্তাবিত। সেই জাতীয় সরকারে অভ্যুত্থানকারী ছাত্র-নাগরিকদের অংশ থাকবে। নাগরিক সমাজসহ পেশাজীবী ও নানা ধরনের পক্ষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে তাঁদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে আমরা একটা অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকারের রূপরেখা এবং সেই সরকারে কারা কারা থাকবে, সেই নামগুলো ঘোষণা করব।’
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে জুলাই: মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু নামে একটি বই লিখেছেন সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ। গত মার্চে প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ওই বইয়ে ৫ আগস্ট রাতের সেই সংবাদ সম্মেলন প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘সংবাদ সম্মেলনের আগমুহূর্তে ওই টেলিভিশনের কার্যালয়ে একটি ছোট সভাকক্ষে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে একটা ভার্চ্যুয়াল বৈঠক হয়।…তারেক রহমানকে আমরা অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকারের প্রস্তাব দিই এবং বিএনপিকে সেই সরকারে অংশগ্রহণের আহ্বান জানাই।…তারেক রহমান বললেন, তাঁরা এ ধরনের কিছুর অংশ হতে চান না।’
এর আগে সেদিন সন্ধ্যায় চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের কার্যালয় থেকে মুঠোফোনে ফ্রান্সে অবস্থানরত অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের (বর্তমান সরকারের প্রধান উপদেষ্টা) সঙ্গেও তাঁদের কথা হয় বলে বইয়ে উল্লেখ করেছেন আসিফ মাহমুদ। তিনি লিখেছেন, ‘তাঁকে আমরা জাতীয় সরকারের ধারণার কথাটাই বললাম। অধ্যাপক ইউনূস বললেন, তিনি ইতিবাচক, তবে অনেকগুলো ব্যাপার আলোচনা করতে হবে।’
রাতে চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের কার্যালয় থেকে বেরিয়ে সমন্বয়কেরা যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। কার্জন হলের একটি সম্মেলনকক্ষে তাঁরা বসেন। রাত ১১টা–১২টার দিকে অধ্যাপক আসিফ নজরুল সেই সম্মেলনকক্ষে যান বলেও নিজের বইয়ে উল্লেখ করেছেন আসিফ মাহমুদ। তিনি লিখেছেন, রাতে বিভিন্ন জায়গা থেকে গোলাগুলি ও ডাকাতির খবর আসছিল। রাতেই তাঁরা আবার অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। দীর্ঘ আলোচনার পর অধ্যাপক ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নিতে সম্মত হলেন। পরে রাত তিনটায় তিনি, নাহিদ ও আবু বাকের ফেসবুকে এক ভিডিওতে অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান হিসেবে অধ্যাপক ইউনূসের সম্মতির বিষয়টি ঘোষণা করেন।