একজন ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে পূজনীয় চরিত্র, অন্যজন অতটা না হলেও দেশটির ক্রিকেট পরিমণ্ডলে পান রাজার সম্মান। এজবাস্টনে সেই শচীন টেন্ডুলকার আর বিরাট কোহলিকেই কি না একটা বিশাল খোঁচা দিয়ে বসেছিলেন ভারতের নতুন কাণ্ডারি শুবমান গিল!
খোঁচাটা অবশ্য প্রত্যক্ষভাবে শুবমান দেননি। দিয়েছেন মাইকেল অ্যাথারটন। বলে বসলেন, ‘শুবমান গিল ভারতের ব্যাটিং লাইন আপের চার নম্বরে বড় শূন্যস্থান পূরণ করছেন, শচীন টেন্ডুলকার, আর বিরাট কোহলির শূন্যস্থান। তবে তিনি এমন একটা অর্জন করে বসেছেন, যা ওই দুজন পারেননি, তিনি ইংল্যান্ডে ডাবল সেঞ্চুরি করে ফেলেছেন!’
পরোক্ষভাবে অবশ্য ‘দায়’ এড়াতে পারেন না ভারত অধিনায়ক। এজবাস্টনের ওই মহাকাব্যিক ২৬৯ রানের ইনিংসে তিনি তো সত্যিই পেছনে ফেলেছেন শচীন আর কোহলিকে।
ইংল্যান্ডে ডাবল সেঞ্চুরি নেই ভারতের দুই কিংবদন্তির। ২০০২ সালে শচীন অবশ্য খুব কাছে গিয়েছিলেন, ১৯৩ রানে শেষ হয়েছিল ইংলিশ মুল্লুকে তার সর্বোচ্চ ইনিংসটা। ২০১৮ সালে কোহলিকে অবশ্য এই এজবাস্টনেই ১৪৯ রানে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। গিল তাদেরই ছাড়িয়ে গেছেন। সেটাও আবার নিজের মোটে দ্বিতীয় ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অ্যাওয়ে সিরিজে।
শুধু শচীন কিংবা কোহলি নয়, এই সফরে তাদেরও পূর্বসূরি ‘লিটল মাস্টার’ সুনীল গাভাস্কারের একটা রেকর্ডও কেড়ে নিয়েছেন। ভারত অধিনায়ক হিসেবে এক সিরিজে সবচেয়ে বেশি রানের কীর্তিটা এতদিন ছিল গাভাস্কারের, ১৯৭৮-৭৯ সালে তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে করেছিলেন ৭৩২ রান। সেটাকে দুইয়ে ঠেলে গিল এই সিরিজে করেছেন ৭৫৪ রান।
গাভাস্কারের আরও একটা রেকর্ডে ভাগ বসিয়েছেন তিনি। সে রেকর্ডে ভাগ আছে ডন ব্র্যাডম্যানেরও। অধিনায়ক হিসেবে এক সিরিজে সবচেয়ে বেশি ৪ সেঞ্চুরি ছিল তাদের। সদ্যসমাপ্ত ইংল্যান্ড সিরিজে সেখানেও নিজের নাম জড়িয়ে দিয়েছেন গিল।
তার অর্জনের মাহাত্ম্য বেড়ে যায় আরও একটা তথ্য যোগ করলে। এবারের ইংল্যান্ড সফরটা আবার ছিল অধিনায়ক হিসেবে তার অভিষেক সিরিজ। সেই সিরিজেই কি-না বাজিমাত করলেন তিনি! আর তাতেই তুলনাটা চলে আসছে দুই কিংবদন্তির সঙ্গে। সে তুলনাটা যদি শুধু পরিসংখ্যানের নিক্তিতে রাখা হয়, তাহলে দেখা যায় গিল শচীন আর কোহলির চেয়ে খুব একটা পিছিয়ে নেই, বরং ক্ষেত্রবিশেষে এগিয়েই আছেন তাদের চেয়ে! গিল এ পর্যন্ত খেলেছেন ৩৭ টেস্ট আর ৫৫টি ওয়ানডেতে। এই দুই মানদণ্ডে যদি গিলের সঙ্গে শচীন আর কোহলিকে তুলনায় রাখা হয়, তখনই বেরিয়ে আসে ফলটা।
এখন পর্যন্ত ৩৭ টেস্টে শুবমান করেছেন ২৬৪৭ রান। তার গড় ৪১.৩৫। নামের পাশে সেঞ্চুরি আছে ৯টি। সর্বোচ্চ ২৬৯ রানের ইনিংসটা খেলেছেন এই সদ্যসমাপ্ত সিরিজেই।
সমান টেস্ট খেলে বিরাট কোহলি অবশ্য এগিয়ে ছিলেন বেশ। তার রান ছিল গিলের চেয়ে ১৪৭টি বেশি। ২৭৯৪ রান তিনি করেছেন ৪৫.০৬ গড়ে। সঙ্গে ছিল তার ১১টি সেঞ্চুরি, সর্বোচ্চ ইনিংস ছিল ১৬৯ রানের।
ওদিকে শচীন রানের দিক থেকে দুই জন থেকেই ছিলেন পিছিয়ে। ৩৭ ম্যাচ শেষে তিনি ২৪৮১ রান তুলেছিলেন। তবে এ সময় গড় দুজনের চেয়ে বেশি তার। ৫২.৭৮ গড়ে রান করেছেন তিনি। সর্বোচ্চ রানের ইনিংস ১৭৯ রানের। সেঞ্চুরি আবার ছিল সবার চেয়ে কম, ৮টি।
ক্ষেত্রবিশেষে গিল চলেছেন শচীন-কোহলির চেয়ে এগিয়ে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে পিছিয়ে। তবে পিছিয়ে থাকলে সেটা যে খুব বেশি ব্যবধানে নয়, তাও এখান থেকেই পরিষ্কার।
এবার চলুন ওয়ানডের হিসেবে। এই ক্ষেত্রে গিল যোজন যোজন ব্যবধানে এগিয়ে দুই কিংবদন্তি থেকে। ক্যারিয়ারের প্রথম ৫৫ ম্যাচে গিল ২৭৭৫ রান করেছেন ৫৯.০৪ গড়ে, সেঞ্চুরি আছে ৮টি, সর্বোচ্চ রানের ইনিংস ২০৮ রানের। প্রথম ৫৫ ম্যাচে কোহলি একটা বিশ্বকাপ জেতার পাশাপাশি করেছিলেন ১৯৫৬ রান, ৪৩.৪৬ গড়ে; সেঞ্চুরি ছিল ৫টি, সর্বোচ্চ রানের ইনিংস ছিল ১১৮টি। শচীনের অবস্থা ওয়ানডে ক্যারিয়ারের শুরুতে ছিল শোচনীয়। ৩২.৩৪ গড়ে ১৫২০ রান, কোনো সেঞ্চুরি নেই, সর্বোচ্চ রানের ইনিংসটা মোটে ৮৪ রানের; এমন কিছু মোটেও শচীনসুলভ নয় নিশ্চয়ই।
গিল এই ফরম্যাটে দুজনকেই পেছনে ফেলেছেন দারুণভাবে। টেস্টেও এক অর্থে বলা চলে। পরিসংখ্যানের দিক থেকে একটু পিছিয়ে থাকলেও অর্জনের দিক থেকে পিছিয়ে নেই। অধিনায়ক হিসেবে প্রথম টেস্ট সিরিজেই অজস্র কীর্তি গড়েছেন, ২-২ ড্র নিয়ে ফিরেছেন ঘরে। এমন কীর্তিতে তো ভারতের সফলতম অধিনায়ক মহেন্দ্র ধোনির মনেও ঈর্ষা জাগিয়েছেন গিল!
এমন পরিসংখ্যান আর কীর্তি থেকে এটা বলা যায় যে, ক্যারিয়ারের শুরুটা শচীন কোহলির চেয়েও ভালো হয়েছে গিলের। সেটাকে নিশ্চয়ই টেনে আরও লম্বাই করতে চাইবেন ভারতের নতুন টেস্ট কাণ্ডারি!