২০২১ সাল। রংপুরের এক তরুণ উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোনোর আগেই উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। নাম নাহিদ হাসান। চার বন্ধুর ৪ হাজার টাকার পুঁজি নিয়ে শুরু করলেন অনলাইন ব্যবসা নাহিদ’স ওয়ার্ল্ড। পরিকল্পনা ছিল, যখন যে ফলের মৌসুম, তখন তাই বিক্রি করবেন। আমের মৌসুমে শুরুটা হলো, কিন্তু সেই শুরুতেই এক ভয়ংকর প্রতারণার শিকার হলেন তিনি। এক ক্রেতার ২৫০ কেজি আমের বড় অর্ডারের ফাঁদে পড়ে ধারদেনা করে প্রায় ১৭ হাজার টাকার আম কিনে পাঠালেন। এরপর সেই লোকের আর কোনো খোঁজ নেই। ব্যবসার শুরুতেই এমন হোঁচট খাবেন, তা নাহিদের কল্পনার বাইরে ছিল। ঋণের বোঝা আর ব্যর্থতার গ্লানিতে প্রতিটি দিন চোখের জলে ভেসেছে তাঁর।
এই ব্যর্থতাই কি শেষ কথা? এটা নাহিদের জন্য নয়। যার শুরুটা হয়েছিল প্রতারণার শিকার হয়ে, কান্নার মধ্য দিয়ে, সেই নাহিদই আজ মাসে এক কোটি টাকার বেশি মাছ বিক্রি করছেন। এটি শুধু একটি ব্যবসার সফলতার গল্প নয়, এটি অদম্য ইচ্ছা, উদ্ভাবনী চিন্তা আর শত প্রতিকূলতা জয় করে টিকে থাকার এক কাব্যগাঁথা। সম্প্রতি রাজধানীর আজিমপুরে নাহিদ হাসানের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে তাঁর কার্যক্রম দেখার সময় তিনি তাঁর গল্পটি তুলে ধরেন এই প্রতিবেদকের কাছে।
নাহিদের আছে কর্মী দল
নাহিদের আছে কর্মী দলছবি: প্রথম আলো
প্রতারণার ক্ষত থেকে নতুন চ্যালেঞ্জ
নাহিদ হাসানের বাড়ি রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার শুকুরের হাট এলাকায়। বাবা মো. শওকত আলী পেশায় কৃষক এবং মা মোছা. নাছিমা বেগম একজন গৃহিণী। দুই ভাইবোনের মধ্যে ছোট নাহিদ বর্তমানে ঢাকা কলেজের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। পাশাপাশি মাছের ব্যবসা করছেন।
নাহিদ বলেন, ‘ব্যবসা শুরুর মাত্র ৮-৯ দিনের মাথায় রাসেল মিয়া নামের এক ব্যক্তি আমার থেকে প্রায় ১৭ হাজার টাকার আম হাতিয়ে নেয়। তখন আমার পুঁজিই ছিল সামান্য। এই ধাক্কা আমার জীবন এলোমেলো করে দেয়। পরিবারের ভয়ে ঘটনাটি কাউকে জানাতে পারিনি। প্রশাসনের কাছে গিয়েও কোনো সাহায্য পাইনি। কিন্তু হার মানিনি।’
আমের ব্যবসায় সর্বস্বান্ত হয়ে নাহিদ নতুন কিছু করার কথা ভাবলেন। এমন কিছু, যা গতানুগতিক নয় এবং মানুষের একটি মৌলিক সমস্যার সমাধান করবে। ভাবনাটা এলো নদীর মাছ নিয়ে। ফরমালিনযুক্ত মাছের ভিড়ে নদীর তাজা মাছ পৌঁছে দেওয়ার চ্যালেঞ্জটা নিলেন তিনি। কিন্তু রংপুরে বসে এই কাজ চালিয়ে যাওয়া কঠিন ছিল।
সরাসরি মাছ সংগ্রহ করা হয় ঢাকার বাইরে থেকে
সরাসরি মাছ সংগ্রহ করা হয় ঢাকার বাইরে থেকেছবি: সংগৃহীত
ঢাকা অধ্যায় ও আবার স্বপ্ন দেখা
উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকায় এসে ঢাকা কলেজে ভর্তি হলেন নাহিদ। এবার নতুন করে স্বপ্ন বোনার পালা। বন্ধু রতন মিয়ার সঙ্গে মেসে উঠলেন। নিজের স্বপ্নের কথা বন্ধুকে জানাতেই তিনিও হাত বাড়ালেন। দুজন মিলে ঢাকায় শুরু হলো নতুন সংগ্রাম। একটি ছোট ঘর ভাড়া নিলেন, যা একই সঙ্গে তাঁদের থাকার জায়গা, অফিস আর মাছ প্যাকেজিংয়ের কেন্দ্র। হাতে থাকা মুঠোফোন দিয়ে ভিডিও বানানো আর নিজের লেখার দক্ষতাকে পুঁজি করে দুই বন্ধু মিলে আবার শুরু করলেন নাহিদ’স ওয়ার্ল্ড-এর যাত্রা, তবে এবার পণ্য হিসেবে ছিল নদীর টাটকা মাছ।
ব্যবসাটা মোটেও সহজ ছিল না। নাহিদ বলেন, ‘এমনও দিন গেছে, মাছের কার্টন নিয়ে আমাদের বাসে উঠতে দেয়নি। বাসের স্টাফরা বুঝতে পারলেই নামিয়ে দিত। ডেলিভারি দিয়ে ফেরার সময় পকেটে খাওয়ার মতো টাকা থাকত না। অনেক বেলা কলা-রুটি খেয়ে দিন পার করেছি।’
পরিবারের চাপও ছিল প্রচণ্ড। বাবা কৃষক হলেও স্বপ্ন দেখতেন ছেলে ভালো ফল করে বড় চাকরি করবে। এসএসসি ও এইচএইচসিতে জিপিএ–৫ পাওয়া ছেলে মাছ বিক্রি করছে, এটা তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না। নাহিদ বলেন, ‘বাবার ভয়ে বাড়িতে যেতাম না। এলাকার মানুষ বাবাকে বলত, “আপনার ছেলে পড়ালেখা ছেড়ে মাছ বেচছে।” বাবা খুব রেগে যেতেন। কিন্তু মা আর বোন সব সময় পাশে ছিল। আজ যখন সফল হয়েছি, তখন সেই বাবাই আমার জন্য অপেক্ষা করেন, দরজা খুলে দেন।’
‘মা, তোমাকে ভালোবাসি’ লেখা প্যাকেট ও সাফল্যে
এখন নাহিদের প্রতিষ্ঠানে ৩৫ জন কর্মী কাজ করেন, যাঁদের প্রায় সবাই বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থী ও আর্থিকভাবে অসচ্ছল। তাঁদের থাকার জন্য দুটি বাসা ভাড়া করে দিয়েছেন নাহিদ। মাসে এক কোটি টাকার বেশি বিক্রি হয় তাঁর। নিজস্ব সরবারহ ব্যবস্থার মাধ্যমে সারা বাংলাদেশে, বিশেষ করে ঢাকায়, তাজা মাছ পৌঁছে দেওয়া হয়। আটটি মোটরসাইকেল নিয়ে তাঁর ডেলিভারি দল ঢাকার অলিগলিতে ছুটে বেড়ায়।
নাহিদের ক্রেতাদের ৬০ শতাংশই প্রবাসী। তিনি বলেন, ‘প্রবাসীরা টাকার চিন্তা করেন না, তাঁরা শুধু বলেন, “ভাই, ভালো মাছটা দিয়েন।” অনেকে আবার অর্ডার দিয়ে বলেন, প্যাকেটের ওপর লিখে দেবেন, “মা, তোমাকে ভালোবাসি।” আমরা তাঁদের সেই আস্থা ও ভালোবাসার মূল্য দেওয়ার চেষ্টা করি।’
বরিশাল, ভোলা, শরীয়তপুর, কিশোরগঞ্জ, খুলনা ও চাঁদপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সরাসরি মাছ সংগ্রহ করা হয়। এই সংগ্রহের কাজেও নাহিদের নিজস্ব লোকবল রয়েছে, যা কর্মসংস্থান তৈরিতে ভূমিকা রাখছে।
ঢাকার মধ্যে মোটরবাইকে সরবরাহ করা হয় মাছ
ঢাকার মধ্যে মোটরবাইকে সরবরাহ করা হয় মাছছবি: প্রথম আলো
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা
নাহিদের স্বপ্ন এখন আরও বড়। তিনি বলেন, ‘আমার স্বপ্ন ছিল এই বছর ১০০ জনের কর্মসংস্থান তৈরি করব, যা এখনো পূরণ হয়নি। তবে শিগগিরই আরও ১৫ জন কর্মী নিয়োগ দিয়ে সংখ্যাটা ৫০-এ নিয়ে যাব। ২০২৮ সালের মধ্যে ১ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাই আমার লক্ষ্য।’
আগামী আগস্ট মাসে বিভিন্ন নদীতে মাছের পোনা ছাড়ার একটি বড় উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি। নাহিদের কথায়, ‘প্রকৃতি আমাদের দিচ্ছে, কিন্তু তারও তো একটা সীমা আছে। আমরা যদি নিজেরা উদ্যোগী না হই, তাহলে মাছের উৎপাদন বাড়বে কীভাবে? নিজেদের জায়গা থেকে এই দায়িত্বটা সবার নেওয়া উচিত।’ নাহিদের ভিডিও অনেক অসাধু মানুষ নিজেদের বলে চালান। এ জন্য বিভিন্ন থানায় অভিযোগ দিয়ে রেখেছেন নাহিদ।
নাহিদ হাসান বলেন, ব্যর্থতা মানেই শেষ নয়, বরং নতুন করে শুরু করার একটি সুযোগ। সঠিক পরিকল্পনা, কঠোর পরিশ্রম আর অদম্য ইচ্ছাশক্তি থাকলে যেকোনো প্রতিকূলতাকে জয় করে সাফল্যের শিখরে পৌঁছানো সম্ভব। আমি একসময়ের ঋণগ্রস্ত, দিশাহারা এক তরুণ আজ অনেকের অনুপ্রেরণার উৎস। এটাই আমার ভালো লাগা সবেচেয়ে বড় পাওয়া।