নির্বাচন কমিশনের অধিকতর যাচাইয়ে নিবন্ধনপ্রত্যাশী ১৩টি রাজনৈতিক দলের কমিটির কার্যকারিতা ও মাঠ কার্যালয়ের অস্তিত্ব নিয়ে আরও খারাপ তথ্য পেয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। তাদের তথ্য, প্রায় সব রাজনৈতিক কার্যালয় ও কমিটির সংখ্যা আগের প্রতিবেদনের চেয়ে কম। বিষয়টি এমন পর্যায়ে যে, জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি ছাড়া অন্য দলগুলো আইন অনুযায়ী নিবন্ধন পাওয়ার শর্ত পূরণ করতে পারছে না। এদিকে আগের এবং অধিকতর যাচাই প্রতিবেদনের তথ্যে বিস্তর পার্থক্য নিয়ে ইসি সচিবালয় কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। দল নিবন্ধন পাইয়ে দিতে ইসির কোনো কোনো কর্মকর্তা আগের প্রতিবেদন কারসাজি করেছেন কি না-এমন প্রশ্নও উঠেছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা যায়, ১৩টি রাজনৈতিক দলের বিষয়ে অধিকতর যাচাই করেছে ইসি। এর মধ্যে নির্বাচন কমিশনের উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বেশ কয়েকটি গ্রুপ এলাকাভিত্তিক ১০টি রাজনৈতিক দলের মাঠ কার্যালয় তদন্ত করে। দলগুলো হচ্ছে-বাংলাদেশ আম জনগণ পার্টি, আমজনতার দল, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক পার্টি (বিজিপি), বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী), বাংলাদেশ জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি, ভাসানী জনশক্তি পার্টি, বাংলাদেশ বেকার মুক্তি পরিষদ, জনতার দল, মৌলিক বাংলা এবং জনতা পার্টি বাংলাদেশ। এছাড়া জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ-শাহজাহান সিরাজ), বাংলাদেশ জাতীয় লীগ ও জাতীয় জনতা পার্টির কমিটির ধারাবাহিকতা, কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও কমিটির অস্তিত্ব যাচাই করে। এসব কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন দু-চারদিনের মধ্যে তাদের সিদ্ধান্ত জানানোর কথা রয়েছে।
অধিকতর যাচাই প্রতিবেদন সম্পর্কে বুধবার জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, সারা দিন বিভিন্ন ধরনের মিটিংয়ে থাকায় আমি ওই প্রতিবেদন দেখার সুযোগ পাইনি। তাই এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারছি না।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধন দিচ্ছে। প্রতিটি নির্বাচনের আগে নিবন্ধন দেওয়ার প্রথা রয়েছে। এবার নিবন্ধন পেতে ১৪৩টি দল আবেদন করে। সর্বশেষ যাচাইয়ে ১৪টি দল নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় রয়েছে। ইসি এনসিপি ছাড়া বাকি ১৩টি দলের বিষয়ে অধিকতর তদন্ত করেছে।
তদন্তের দায়িত্বে নিয়োজিত ইসির একাধিক কর্মকর্তা নাম গোপন রাখার শর্তে জানান, তারা ইতোমধ্যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। যাচাই কমিটিতে তিন সদস্যের প্রতিনিধি থাকায় সেখানে ভুল বা ইচ্ছাকৃতভাবে কারও পক্ষে বা বিপক্ষে প্রতিবেদন দেওয়ার সুযোগ নেই। সর্বশেষ ও আগের প্রতিবেদনের মধ্যে পার্থক্যের বিষয়ে তারা বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো অনেক সময় নিবন্ধন নেওয়ার জন্য অস্থায়ী ভিত্তিতে কার্যালয় ভাড়া নেয় অথবা সাময়িক সময়ের জন্য সাইনবোর্ড লাগিয়ে থাকে। এসব কারণে হতে পারে। এছাড়া ইসি সচিবালয় ও মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের যোগসাজশের বিষয়টিও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, এনসিপি ও বাংলাদেশ জাতীয় লীগকে নিবন্ধন দেওয়ার তালিকায় রেখেছে ইসি। অধিকতর যাচাইয়ে জাতীয় লীগের দলীয় প্রতীকে সর্বশেষ আসন লাভের পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত দলের কার্যক্রমে ধারাবাহিকতা ও নিরবচ্ছিন্নতা পাননি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এ দলটি নিয়ে এনসিপিও ইসিতে আপত্তি জানিয়েছিল। এ দলটি গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিওর) ৯০খ(১)(ক)(অ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নিবন্ধন আবেদন করেছিল। এ উপ-অনুচ্ছেদে বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর একটি আসনে দলীয় প্রতীকে কমপক্ষে একটি আসন পেলে সেই দলটি নিবন্ধন পাওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হয়। একই অবস্থা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ-শাহজাহান সিরাজ) এবং জাতীয় জনতা পার্টির। এ দুটি দলও ইসির প্রাথমিক তালিকায় রয়েছে।
আরপিওর ৯০খ(১)(ক)(ই) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নিবন্ধন আবেদন করেছে বাংলাদেশ আম জনগণ পার্টি। এ অনুচ্ছেদে অন্তত ২১টি জেলা ও ১০০টি উপজেলায় কার্যালয় ও কমিটি থাকার নিয়ম রয়েছে। অথচ অধিকতার যাচাইয়ে এ দলটির ২১টি জেলা ও ৭০টি উপজেলায় কার্যালয় ও কমিটির কার্যকারিতার তথ্য পেয়েছেন ইসির কর্মকর্তারা। অথচ আগের প্রতিবেদনে ২০টি জেলা ও ৯৯টি উপজেলায় কমিটি ও কার্যালয় থাকার তথ্য পেয়েছিল। অর্থাৎ অধিকতর যাচাইয়ে দলটির আগের চেয়ে একটি জেলা কার্যালয় বেশি এবং উপজেলা কার্যালয় ২৯টি কম পেয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ আমজনগণ পার্টির আহ্বায়ক মোহাম্মদ রফিকুল আমীন যুগান্তরকে বলেন, ইসির ওপর কেউ অদৃশ্য চাপ দিচ্ছে, যা কাউকে শেয়ার করতে পারছে না। এ কারণে প্রতিবেদনের ফলাফল এমন হচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা ইসির সিদ্ধান্ত পাওয়ার ভিত্তিতে আইনি লড়াই ও রাজপথের কর্মসূচি ঠিক করব। তাদের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি।
অধিকতর যাচাইয়ে আমজনতার দলেরও কার্যালয় ও কমিটির সংখ্যা আগের চেয়ে কম পাওয়া গেছে। এ দলটির ৪টি জেলা ও ১৩টি উপজেলায় কার্যালয় ও কমিটির অস্তিত্ব পেয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। অথচ আগের প্রতিবেদনে আটটি জেলা ও ৩টি উপজেলা কার্যালয় পাওয়ার তথ্য উল্লেখ ছিল। জানতে চাইলে দলটির সদস্য সচিব মো. তারেক রহমান যুগান্তরকে বলেন, আমরা ২৫টি জেলা ও ১০৮টি উপজেলার তথ্য জমা দিয়েছি। প্রতিটি উপজেলায় ইসির কর্মকর্তারা জাননি। অধিকতর যাচাইয়ে ২০টি জেলা ও ৬৬টি উপজেলায় ইসি কর্মকর্তারা গিয়েছেন। তারা যেহেতু সব কার্যালয়ে যাননি, তাই প্রতিবেদন এমন হচ্ছে।
একইভাবে অধিকতর যাচাইয়ে গণতান্ত্রিক পার্টির (বিজিপি) একটি জেলা ও ৬টি উপজেলা কার্যালয় ও কমিটির তথ্য উঠে এসেছে। অথচ আগের প্রতিবেদনে এ দলটির ১৩টি জেলা ও ৭০টি উপজেলা কার্যালয়ের অস্তিত্ব পাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। আরেক রাজনৈতিক দল মৌলিক বাংলার ৪টি জেলা ও ৮টি উপজেলায় কার্যালয় ও কমিটি থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আগের প্রতিবেদনে ৫টি জেলা ও ১৭টি উপজেলার কার্যকারিতা পেয়েছিল বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল।
অন্যান্য দলের মধ্যে বাংলাদেশ বেকার মুক্তি পরিষদের ৫টি জেলায় ও ৩৪টি উপজেলায়, ভাসানী জনশক্তি পার্টির ৪টি জেলা ও ৫টি উপজেলায়, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (মার্কসবাদী) ৪টি জেলা ও ৫১টি উপজেলা, বাংলাদেশ জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির একটি জেলা ও একটি উপজেলায় কার্যালয় ও কমিটির কার্যকারিতা পেয়েছে অধিকতার যাচাই কমিটির সদস্যরা।
ইসির কর্মকর্তারা জানান, অধিকতর যাচাই কমিটিগুলোর প্রতিবেদন শিগ্গিরই ইসির কাছে উপস্থাপন করা হবে। ইসি যে সিদ্ধান্ত দেবে, সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তারা আরও জানান, এনসিপিকে শাপলা প্রতীক না দেওয়ার বিষয়ে এখনো অনড় অবস্থানে কমিশন। দলটিকে কলম বা মোবাইল প্রতীক দেওয়ার চিন্তা করা হচ্ছে।

