বাংলাদেশের জনসমাজের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় নিয়ে নানা বিতর্ক ও রাজনীতি আছে। প্রথম যুগের ভারতীয় ইতিহাসকারেরা সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিতে পড়ে বাংলাদেশের মানুষদেরকে আর্য উৎসের বলে প্রচার করেছেন। আবার পরবর্তীকালের লেখক যেমন রাখাল দাস বন্দ্যোপাধ্যায়, রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ এইমর্মে অপপ্রচার চালিয়েছেন যে, বাংলাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই নিম্নশ্রেণির হিন্দু হতে জাত দেয়া মুসলমান। তাদের এই সাম্প্রাদায়িক রাজনীতির কথা এখন সচেতন মানুষদের কাছে পরিষ্কার। এ সত্ত্বেও বাংলাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর ঘরাণা নিয়ে বিভ্রান্তি আছে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষদের মধ্যে। বর্তমান প্রবন্ধের উদ্দেশ্য হলো ঐতিহাসিক তথ্যের ভিত্তিতে এইসব বিভ্রান্তি দূর করে আমাদের নৃতাত্ত্বিক ঘরানা সম্পর্কে একটা পরিষ্কার ধারনা দেয়া। এজন্য একেবারে শুরু থেকে অর্থাৎ এ অঞ্চলে মানুষের বসতির সূচনা হতে আলোচনা করা দরকার।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন পূর্ব আফ্রিকার বিভিন্ন মানব গোষ্ঠী সত্তর হাজার থেকে এক লক্ষ বছর আগে এশিয়া এবং ইউরোপের দিকে রওয়ানা দেয়। চলে আসে আরব উপদ্বীপে, বিশেষ করে ইয়েমেন সৌদি আরব ওমানে। ওদের একটা অংশ আনুমানিক পঞ্চাশ-ষাট হাজার বছর আগে ভারতের উপকূল অঞ্চলে আসে। আরো পরে সেখান থেকে পুবে এগিয়ে ধীরে ধীরে বাংলাদেশে এসে বসত শুরু করে। কেউ কেউ আবার এখান থেকে দক্ষিণ দিকে বার্মা, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশ হয়ে অস্ট্রেলিয়ায় পৌছে যায়। এভাবে ভারত থেকে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়া মানবগোষ্ঠীটিকে বলা হয় আদিঅস্ট্রেলীয় বা ভেড্ডিড। প্রথম ধাপে আসা আদিঅস্ট্রেলীয় বা ভেড্ডিদের নিয়েই মূলত বাংলাদেশের জনসমাজ গড়ে উঠেছে। এরাই বাংলার আদি বাসিন্দা, আমাদের পূর্বপুরুষ।
আন্দাজ করা যায় বাংলাদেশের দক্ষিণের বহু এলাকা তখন সমুদ্রের পানির নিচে। সারাদেশে মোট মানুষের সংখ্যা ছিলো আজকের তুলনায় সামান্য। ষাট হাজার বছর আগে গোটা পৃথিবীর জনসংখ্যা অনুমান করা হয় ২-৩ লাখ। সেই হিসাবে সারা বাংলাদেশে কয়েক হাজার মানুষ ছিল কি না সন্দেহ।
আমাদের সেইসব পূর্বপুরুষের জীবনযাপন সম্পর্কে ভালো করে জানার কোন উপায় নেই। আমরা মাত্র আড়াই হাজার বছর আগের লিখিত বিবরণ পাই। এর আগের ইতিহাস একেবারে ফকফকা সাদা। কিছু লিখিত তথ্য পাওয়া যায় আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে লেখা গ্রীক ইতিহাসে। তাদের বর্ণনা থেকে জানা যায় ইন্ডিয়ার সব থেকে পুবে এ অঞ্চলে এক জাতি বাস করতো। তাদের গায়ের রঙ ছিলো বাদামী। এরা কার্পাস তুলার সুতায় বুনা কাপড় পরত। আবার পাটের সুতোয় বুনা কাপড়ের কথাও জানা যায়।
এ অঞ্চলে আরেক দল মানুষের বসবাসের কথা বলা হয়েছে যারা জীবিত প্রাণী হত্যা করতো না। চাষবাস করতো না। প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো ফলফসল থেকে জীবন নির্বাহ করতো। বিবরণ থেকে মনে হয় এটি ছিলো বাংলাদেশের প্রথম বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী সমাজ।
গ্রীক লেখকদের বর্ণনা থেকে জানা যায় পদ্মা নদী শেষ দিকে পাঁচটা শাখায় ভাগ হয়ে সাগরে পড়েছে। পদ্মার এই পাঁচ শাখা বা পাঁচ মুখের আশঅপাশের সব এলাকা নিয়ে ছিলো এক শক্তিশালী রাজ্য। গ্রীক ইতিহাসবিদরা সেই রাজ্যকে বলেছে ‘গঙ্গারিডি’ রাজ্য। বলা হয়েছে পাটনা হতে গঙ্গারিডির দূরত্ব ৬৩৭ মাইলের মত। পাটনা হতে মেঘনার মোহনার দূরত্ব মোটামুটি এরকমই। এ থেকে আন্দাজ করা যায় গঙ্গারিডি নামের দেশটা ছিলো বাংলাদেশের দক্ষিণ অংশ। বলা যায় আজকের সন্দ¦ীপ থেকে শুরু করে উপরের দিকে নোয়াখালীর এক অংশ, ঢাকা, বরিশাল, ফরিদপুর ও খুলনার নিচের অংশ গঙ্গারিডি দেশভুক্ত ছিলো।
গঙ্গারিডি নামটা আসলে ‘গাঙ্গাড়ি’ শব্দের গ্রীক ভার্সন। বাংলাদেশে অনেক জায়গা বা খালবিলের নাম গাঙ্গারি, গাঙনি, গাঙ্গুর এইসব। শব্দটা এসেছে গাঙ থেকে। বাংলাদেশের প্রায় সকলে নদীকে বলে গাঙ। নদী কথাটি এসেছে অনেক পরে প্রমিত বাংলার বদৌলতে। ‘গাঙ’ হলো সকল সাধারণ মানুষের ভাষার শব্দ। আরেকটা খাঁটি বাংলা শব্দ হলো ‘আড়ি’ বা ‘আড়’, যার অর্থ উঁচু জায়গা বা উঁচু বাধা। এ থেকে হয়েছে বালিয়াড়ী অর্থাৎ বালি জমে বিস্তীর্ণ উঁচু জায়গা। আর ‘গাঙেরআড়ি’ হলো গাঙের পাড়ের বেশি উঁচু জায়গা যা হয়ত অতিরিক্ত পলি জমে সৃষ্টি হয়েছে।
সে কালে বাংলার দক্ষিণ অঞ্চলে ছিল বহু গাঙের স্রোত। বছরের বেশির ভাগ সময় আশপাশ পানিতে সয়লাব হয়ে থাকত। এরকম বহু গাঙ বিলে সয়লাব এলাকায় গাঙপাড়ের উঁচু জায়গা অর্থাৎ গাঙ্গারি অঞ্চলগুলো ঘিরেই মানুষের সমাজ গড়ে উঠেছিলো। বাইরের লোকেরা তাদেরকে হয়ত বলত ‘গাঙেরআড়ির দেশের মানুষ’। এ থেকে এলাকার নামই হয়ত হয়ে গেছে গাঙ্গারি। ‘গাঙ্গারি’ শব্দটি গ্রীকদের লেখায় ‘গঙ্গারিডি’ হিসাবে উল্লেখিত হয়ে থাকবে।
এই গাঙ্গারি দেশের মানুষেরা ছিল অত্যন্ত স্বাধীনচেতা, শক্তিশালী যোদ্ধা জাতি। ষাট হাজার পদাতিক, এক হাজার ঘোড়সওয়ার আর সাতশ হাতি নিয়ে বিশাল সেনাবাহিনী ছিল এ দেশের। এসব কথা শুনেই নাকি বিশ্ববিজয়ী আলেকজান্ডার আর এদিকে বা বাড়ানোর সাহস পায়নি। গ্রীক লেখকদের থেকে দ্বিতীয় শতক গাঙ্গারি বা গঙ্গারিডি দেশটির বিবরণ পাওয়া যায়।
বঙ্গ নামের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ভারতের দিল্লীতে ষোলশ বছর আগের রাজা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তর প্রশংসা করে লেখা লোহার এক স্তম্ভের লেখায়। এর পর থেকে আমাদের সময় পর্যন্ত বঙ্গ নামটি চলে এসেছে। কুমিল্লা লক্ষীপুর নোয়াখালী অঞ্চলটি তখন সমতট নামে পরিচিত ছিলো। তার উপরের দিকে সিলেট পর্যন্ত ছিলো হরিকেল রাজ্য। বঙ্গ কখনো কখনো সমতট ও হরিকেলসহ বিস্তৃত ছিলো।
বঙ্গ নাম কোথা থেকে এলো এই নিয়ে অনেক মজার গল্প আছে। যেমন কোনো কোনো মুসলমান বিশ্বাস করেন মহাপ্লাবনের পর নূহ (আ:)এর পুত্র হামের ছেলে ও নাতিরা ভারতের বিভিন্ন জায়গায় বসতি করে নিজ নিজ নামে দেশ গড়ে তুলে। এক নাতির নাম ছিলো ‘বঙ’। সে এসেছিলো এ অঞ্চলে। তার নাম থেকেই বঙ্গ নামটি এসেছে।
আবার হিন্দুরা মনে করে কোনো এক কালে বলী নামক এক রাজা নিজে সন্তান উৎপাদন করতে না পেরে নিজের স্ত্রীকে এক ঋষির সাথে শারিরীকভাবে মিলিত হওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। এর ফলে তার স্ত্রীর পাঁচটি পুত্র হয়। এদের একজনের নামে ছিল ‘বঙ’। তার নামেই এ দেশের নাম হয়েছে বঙ্গ। যাইহোক, এসব কাহিনীর ঐতিহাসিক ভিত্তি বা প্রমাণ নেই বলে সেগুলো আলোচনা অদরকারি। দরকারী কথা হলো যে, গ্রীকদের পরে গঙ্গারিডি নামটার উল্লেখ আর দেখা যায় না। বরং বঙ্গ নামটিই স্থায়ীভাবে পাওয়া যায়।
ধারনা করা হয় বর্ষাকালে বন্যার হাত হতে বাঁচার জন্য প্রাচীন বঙ্গে চাষের এলাকার চারদিকে উঁচু উঁচু আল বা জাঙ্গাল দিয়ে ঘেরাও করা হতো। বঙ্গ কথাটির সাথে এই আল কথাটি যুক্ত হয়ে বঙ্গাল বা বঙ্গাল দেশ ও জাতি নাম সৃষ্টি হয়ে থাকতে পারে। আবার ‘জাঙ্গাল’ শব্দটিও ‘বাঙ্গাল’ রূপান্তরিত হয়ে তাকতে পারে। এ থেকেই ‘বঙ্গালী’ ও ‘বাঙালি’ শব্দের উৎপত্তি । বঙ্গের বাসিন্দা অর্থে বঙ্গালী কথাটাও অনেক প্রাচীন। প্রায় বারোশ বছর আগের কবি ভুসুকু পা’র কবিতায় আছে যে, বঙ্গালেরা পদ্মা খাল (পদ্মা নদি) বেয়ে এসে দেশ লুটে নিয়ে যাচ্ছে।
তিন জন রাজার নাম জানতে পারি যারা ৫০০-৬০০ সময়ের মধ্যে বঙ্গের রাজা ছিলেন। এরপর পাওয়া যায় খড়গ বংশ রাত বংশ প্রভৃতির কথা। এসব রাজারা বঙ্গ-সমতট শাসন করেন।
৪১২ খ্রিস্টাব্দে চীনা সফরকারী ফাজিয়ান কলিকাতার কাছে তমলুকে এসে দুই বছর ছিলেন। তিনি উল্লেখ করেছেন সারা ভারতে তখন বৌদ্ধ ধর্মের প্রাধান্য। আবার ফরিদপুর, ঢাকা, কুমিল্লা প্রভৃতি এলাকায় পাওয়া প্রাচীন তামার পাতের লেখা থেকে দেখা যায় ফাহিয়েনের সময় থেকে শুরু করে পরের দুইতিনশ বছর প্রাচীন বঙ্গ, সমতট ও হরিকেলে বৌদ্ধ রাজারা রাজত্ব করেছেন।
আরেক চীনা সফরকারী হিউয়েন সাঙ ৬৩৮ সালে বাংলাদেশে এসে বাংলাদেশের মেহেরপুরের কাছে কর্ণসুবর্ণ, বগুড়ার মহাস্থানগড়, কুমিল্লার ময়নামতি প্রভৃতি জায়গা ঘুরে লিখেছেন এসব জায়গায় ৬৩টি বৌদ্ধ সংঘারাম (বৌদ্ধদের ইবাদত করার বিশাল প্রতিষ্ঠান) মিলে ছয় হাজার বৌদ্ধ সাধক বাস করে। তিনি লিখেছেন তখন বাংলাদেশের বৌদ্ধ ধর্মের মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। শাসকরাও বৌদ্ধ। এরপর জৈন ধর্মের মানুষ। অন্য কোনো ধর্মের কথা তিনি আলাদাভাবে উল্লেখ করেন নাই বলে মনে হয় সেসব ধর্মের লোকসংখ্যা ছিলো নগন্য।
আবার ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ হতে আমরা লিখিতি ইতিহাস পাই। জানতে পারি ৭৫০ খিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে বৌদ্ধ ধর্মের মানুষ গোপাল বাংলাদেশের রাজা হন। গোপাল দক্ষিণ বঙ্গেও অর্থাৎ ফরিদুপুর-বরিশালের মানুষ ছিলেন বলেই মনে হয়। এই বৌদ্ধ শাসক ক্ষমতায় বসার পর থেকে প্রায় পৌণে চারশ বছর বাংলাদেশ বৌদ্ধ শাসনের চলেছে। বৌদ্ধ ধর্ম অহিংস ধর্মে, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ করে না। জীব মাত্রই দয়া দেখায়।
বৌদ্ধ ধর্ম ও সাধারণ বৌদ্ধরা অহিংস হলে কি হবে, বৌদ্ধ রাজারা বেশ শক্তিশালী যোদ্ধা ছিলেন। তারা আশপাশের বিভিন্ন দেশ আক্রমণ করে দখল করে নিতেন। প্রথমেই এখনকার ভারতের পশ্চিমবঙ্গ তাদের রাজ্যের মধ্যে এসে যায়। ক্রমে বৌদ্ধ শাসকরা বাংলাদেশটাকে ভারতের পাটনা পর্যন্ত বাড়িয়ে নিয়েছিলেন। এরা পৌণে চারশ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। এদের মধ্যে গোপাল, ধর্মপাল, রাজ্যপাল, দেবপাল বেশ সফলভাবে খ্যাতিমান।
তখন সারা বাংলাদেশেই অহিংস বৌদ্ধ ধর্মের প্রাধান্য। সে যুগের সমাজে সাধারণ মানুষের শান্তি শৃঙ্খলা উন্নতিতে ধর্ম খুব প্রভাব রাখতো। শান্তিকামী বৌদ্ধদের মানবিক চিন্তাভাবনা ও মানুষে মানুষে ভেদাভেদহীন জীবন যাপন, পরোপকারী মনোভাব বাংলাদেশে শান্তি, সমৃদ্ধি, জ্ঞান ও সাংস্কৃতিক চর্চার পরিবেশ বিরাজ করছিল।
তখন জ্ঞানচর্চার জন্য সারা দেশে অনেক বৌদ্ধ বিহার গড়ে উঠে। বিহারগুলোকে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় সাথে তুলনা করতে পারি। সেখানে উঁচু শ্রেণির বয়স্ক ছাত্ররা পড়াশোনা করত। যেমন নওগাঁর পাহাড়পুরে সোমপুর বিহার, কুমিল্লার ময়নামতিতে শালবন বিহার জগতে বিখ্যাত। এ ছাড়া রাজশাহী, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, পাবনা, নরিসিংদীসহ অনেক জায়গায় বৌদ্ধ বিহার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো।
বৌদ্ধদের ভাষা ছিল বাংলা। তাদের মুখেই বাংলাভাষার বিকাশ ঘটে। লেখা হয় বাংলা ভাষার প্রথম সাহিত্যিক রচনা ‘চর্যাপদ’। চর্যাপদের আসল নাম হলো ‘আশ্চর্যচর্যাবিনিশ্চয়’। এতে সাত শতক হতে দশ শতক পর্যন্ত বিভিন্ন কবির লেখা সাড়ে সাত চল্লিশটি কবিতা আছে।
১১৩০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে তৎকালীন বৌদ্ধ রাজার এক অধীনস্থ শাসক বিজয় সেন বাংলাদেশ দখল করে নেয়। বিজয় সেন ও তার বংশ বাংলাদেশের মানুষ নয়। তারা এসেছিলেন ভারতের কর্নাটক থেকে। সেনেরা সত্তর বছরের কিছু বেশি সময় বাংলাদেশ শাসন করে। বিজয় সেনের মৃত্যুর পর তার ছেলে বল্লাল সেন রাজা হন। বল্লালের মৃত্যুর পর রাজা হন তার ছেলে লক্ষন সেন।
বল্লাল সেন ও লক্ষন সেনের সময়েই বাংলাদেশে প্রথমবারের মত মানুষকে জোরপূর্ব্বক ধর্ম গছিয়ে দেয়ার চেষ্টা শুরু হয়। বাংলাদেশে ব্রাহ্ম্যণ্য ধর্ম প্রচারের জন্য ইন্ডিয়া থেকে অনেক ব্রাহ্মণ এনে বিভিন্ন গ্রামে জায়গাজমি দিয়ে বসত করানো হয়। বৌদ্ধদের উপর রীতিমত অত্যাচার শুরু হয়ে যায় শাসকদের মদদে। বৌদ্ধদেরকে ব্রাহ্মণ্যধর্মের অর্থাৎ আজকের হিন্দু ধর্মের মানুষ বানানোর জন্য নানা নির্যাতন চলতে থাকে।
সেন রাজারা বাংলাভাষী ছিলেন না। তাই দেশে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম প্রচারের পাশাপাশি সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য প্রসারের চেষ্টা চলতে থাকে। শাসকদের নির্যাতনের মুখে কিছু কিছু মানুষ ব্রাহ্মণ্য ধর্ম গ্রহণ করে। তবে বহু জ্ঞানসাধক বৌদ্ধ বইপুস্তক সহ নেপাল তিব্বত প্রভৃতি দেশে পালিয়ে যান। ফলে বাংলাদেশে বাংলা ভাষার চর্চাও বন্ধ হয়ে যায়। এ কারণে পরের শখানেক বছর কোনো প্রাচীন বাংলা বই পাওয়া যায়নি। এই যুগটাকেই বলে বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ।
সেন শাসনের সময় বিদেশী সংস্কৃত ভাষাকে বড় করার জন্য সংস্কৃতে বই পত্র লেখা ও প্রচারের জোরজবরদস্তি চলে। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বিহারগুলাও আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশের জনমানুষের জ্ঞান চর্চার দীর্ঘ ঐতিহ্য প্রায় থেমে যায়। মুসলমান শাসকরা বাংলাদেশে সুশৃঙ্খলা স্থিতিশীল অবস্থা ফিরিয়ে আনার আগ পর্যন্ত এই অন্ধকার অবস্থাই বিরাজ করে।
সেন ও ব্রাহ্মণ্যগোষ্ঠী বাংলাদেশের জনসমাজের সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটা করে তাহলো ভেদাভেদহীন মানবিক জনসমাজে মানুষে মানুষে বিভেদের জন্ম দেয়। তারা প্রচার করে ব্রাহ্মণরা হলো দেবতাদের প্রতিনিধি। তারা সবার উপরে। এরপর যোদ্ধা ক্ষত্রিয় জাতি। তারপর ব্যবসায়ী বৈশ্যর। এর নিচে যারা আছে তারা কাজের মানুষ। ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়দের সেবা করার জন্য তাদের জন্ম। নিম্নশ্রেণির মানুষেদের গ্রামের এক দিকে জায়গা দেয়া হয়। তারা ব্রাহ্মণদের গায়ে লাগতে পারত না। এমনকি ব্রাহ্মণদের ছায়াও যেন তাদের সাথে না লাগে সেরকম ধর্মীয় ফতোয়া দেয়া হয়। বৌদ্ধবাংলার ভেদাভেদিহীন উদারপন্থী মানবিক জনসাজে এভাবেই বিভেদের বীজ রুইয়ে দেয় সেন শাসকরা। এর ফলে বাংলাদেশের শান্তিপূর্ণ মানবিক দরদী জনসমাজের ধ্বংস সূচিত হয়।
সেন শাসকগোষ্ঠী ও ব্রাহ্মণ্যবাদীদের অত্যাচারে নিরুপায় হয়ে বাংলাদেশের জনসমাজের প্রতিনিধি হিসাবে কয়েকজন বৌদ্ধ সাধক বিহারে গিয়ে বখতিয়ার খিলজির সাথে দেখা করেন। তুর্কি বংশের মানুষ মালিক-উল-গাজী ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ ইবনে বখতিয়ার খিলজি তখন বিহারের শাসক।
এরমধ্যে বীর অভিযানকারী হিসাবে বখতিয়ারের নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় বৌদ্ধ জনসমাজের দাওয়াত পেয়ে ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে লক্ষণ সেনের রাজধানী দখল করেন বখতিয়ার খলজী। লক্ষন সেন পালিয়ে ঢাকার দিকে চলে আসেন। বখতিয়ার খলজীর উত্তরবঙ্গ জয়ের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশে মুসলমানদের শাসন আরম্ভ হয়। অবশ্য এর তিনচারশ বছর আগে থেকে বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চল অর্থাৎ চট্টগ্রাম থেকে বরগুনা পর্যন্ত আরব অঞ্চলের কিছু কিছু মুসলমান বসত শুরু করেছিল।
বাংলায় তুর্কি শাসন কায়েম হওয়ায় পর মধ্যএশিয়া, ইরান, আরব, ইন্ডিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে দলে দলে মুসলিম সৈনিক, ব্যবসায়ী, সাধারণ মানুষ বাংলায় এসে বসত করতে থাকে। সেই সঙ্গে ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে আসেন প্রচুর পীর, ফকির, সুফি দরবেশগণ। এসব পীর ফকির সুফি দরবেশগণ ছিলেন উদারপন্থী। তাদের মধ্যে ছিল সকলের মানুষের প্রতি অপরিসীম দরদ। তারা অন্তর হতে বিশ্বাস করতেন আল্লাহর দুনিয়ায় সকল মানুষই সমান। এঁরা বাংলায় এসে নির্যাতিত জনমানুষের কাছে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের আহবান জানান।
তখনও বৌদ্ধরাই ছিল সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ। তারা দেখে যে এই নতুন ধর্মে সকল মানুষই সমান। বৌদ্ধধর্মের ‘সকল জীবে দয়া করার’ মনোভাব এদের মধ্যে আছে। তার উপর এরা সকল মানুষের প্রতি সমান দরদী। একে অপরের সাহায্যে হাত বাড়িয়ে দেয়। এই নতুন ধর্ম তাদের কাছে বৌদ্ধ ধর্মের মতই কিন্তুু আরও উদার এক ছায়া বলে মনে হয়। এসব কারণে বৌদ্ধরা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করে। যেসব বৌদ্ধ ছিলো সমাজের অগ্রগামী অংশ, যারা বখতিয়ার খলজীকে বাংলা আক্রমণের জন্য ডেকে এনেছিলেন তারা এবং তাদের অনুসারীরাই প্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। অর্থাৎ বৌদ্ধ জনসমাজের সবচেয়ে অগ্রসর, শিক্ষিত, জ্ঞানসাধক গোষ্ঠীটিই প্রথমে মুসলমান হয়।
বিপুল পরিমাণ বৌদ্ধ ইসলাম গ্রহণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে অচিরেই বেশ সমৃদ্ধ একটি মুসলিম জনসমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এটিই বাংলাদেশের প্রথম যুগের মুসলিম জনসমাজ। প্রথম যুগের এই মুসলিম জনসমাজে যারা ছিলো তারা হলো (১) আরব-ইরান-মধ্যএশিয়া-ইন্ডিয়া হতে আগত আধ্যাত্মিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ সুফিগণ ও তাদের শিষ্যসাগরেদ, (২) বাংলাদেশের জনসমাজের অগ্রসর অংশ জ্ঞানী বৌদ্ধগণ, (৩) আরব-ইরান-মধ্যএশিয়া-ইন্ডিয়া হতে আসা বীর সৈনিকদল, (৫) আগত সাধারণ মুসলমান এবং (৬) প্রকৃতি ধর্মের সাধারণ আদি-অস্ট্রেলীয় মানুষ। অর্থাৎ প্রথম যুগের মুসলিম জনসমাজ ছিলো বাংলাদেশের সবচেয়ে অগ্রসর, সবচেয়ে জ্ঞানী ও সচেতন মানুষের মেলা। পরবর্তী সময়েও এই ধারা অব্যাহত হতে থাকে। দুই তিনশ’ বছরের মধ্যে মুসলমানরা বাংলাদেশের সবচেয়ে অগ্রসর, শিক্ষিত এবং বড় ধর্মীয় জনসমাজ হিসাবে আবির্ভুত হয়।
উনিশ শতকে বৃটিশ শাসন কায়েম হওয়ার পর তাদের মদদে এই প্রকৃত ইতিহাস চাপা দিয়ে লেখা হয় বাংলাদেশের এক বানোয়াট ইতিহাস। প্রচার করা হয় এদেশের মুসলমানদের বেশিরভাগই নিম্নশ্রেণির হিন্দু থেকে জাত দেয়া মানুষ। এই সব অপপ্রচারের রেষ এখনো রয়ে গেছে। এখন সময় এসেছে বাংলাদেশের জনসমাজের প্রকৃত ইতিহাস আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর পাঠসূচীসহ সবখানে অঙ্গীভূত করা যাতে আমাদের পরের প্রজন্মের মানুষ তাদের পূর্বপুরুষদের গৌরবময় ইতিহাস জেনে মানুষ হিসাবে সেভাবে নিজেদেরকে প্রস্তুত করতে পারে, শামিল হতে পারে বিশ্বমানবতার অগ্রযাত্রায়।
———————–